মাও জে দং, জ্ঞান ও অনুশীলন - আজফার হোসেন
এই ‘ফরমুলেশন’-টা মাও জে দং-এরঃ যাকে ‘জ্ঞান’ বলা হয়, এমনকি যাকে ‘সঠিক জ্ঞান’ হিসাবে বিবেচনা করা চলে, সেই জ্ঞান আকাশ থেকে হুট করে নাজিল হয় না, কিংবা তা আবার ভূমি ফুঁড়ে হাজিরও হয় না, কিংবা আবার সেই জ্ঞান আগেভাগেই সময়-ও-স্পেসেও নিহিত বা স্থির থাকে না; বরঞ্চ সেই জ্ঞান আসে বিভিন্ন ধরনের অনুশীলন থেকেই এমনভাবে যে, চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে জ্ঞানকে অনুশীলন থেকে বিছিন্ন করা যায় না।
এই ‘ফরমুলেশন’-টা ন’কে এবং ‘অনুশীলন’কে সাধারণ অর্থে নিলে চলবে না। অর্থাৎ ‘জ্ঞান’ মানে কেবল ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা নয়, যে ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাকে অবশ্য হিউম-প্রভাবিত (এখানে লক এবং বার্কেলিও বাদ যাবেন না) পশ্চিমা দর্শনের ‘এম্পিরিসিজম’-নামের ধারাটি গুরুত্ব দিয়েছে। আবার এই ‘অনুশীলন’ মানে ‘বিশুদ্ধ’ চিন্তাচর্চা নয়, কেবল চিন্তাকে নিয়েও চিন্তা করা নয়, যার বিভিন্ন ‘অনুশীলন’ এর মধ্যেই আমরা পশ্চিমা মুলুকে লক্ষ্য করেছি, সেই হাইডেগার থেকে শুরু করে আজকের আল্যান বাদিউ পর্যন্ত, যদি আমরা কেবল বিশ ও একুশ শতকের কথাই ধরি।
এখানে গাণিতিক জ্ঞানের প্রসঙ্গও চলে আসে। দেকার্ত-স্পিনোজা-লাইবনিজ-প্রভাবিত দার্শনিক ধারার একটা বিশেষ অংশ—যাকে ‘র্যাশনালিজম’ নামে ডাকা হয়—সেই অংশের আবার আরেক বিশেষ অংশ ওই গাণিতিক জ্ঞানকে চূড়ান্ত, একপেশে গুরুত্ব দিয়েছে এমনভাবে যে, গণিতকে যেন ‘সব-পেয়েছির-দেশ’ মনে হয়; অর্থাৎ, ওই ধারা মোতাবেক (স্পিনোজার কথা অবশ্য আলাদা এবং সেটি আরেক প্রসঙ্গ), কেবল গণিত-ই পারে সবকিছুর—প্রকৃতি, মন, জীবন এবং জগত-মহাজগতের—অন্তর্গত কাঠামোর সঠিক জ্ঞান দিতে।
মাও মোটেই গণিত-বিরোধী ছিলেন না। চীনে গণিত নিয়ে খোদ মার্কসের ঢাউস পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হলে দারুণ আগ্রহ সহকারে মাও গণিত-চর্চার ওপর জোর দিয়েছিলেন তাঁর মতো করেই এবং এই বুঝিয়েও যে, বিশেষ বিশেষ জ্ঞান বিশেষ ধরণের গণিত-চর্চা থেকে আসতে পারে ঠিক-ই, তবে অনুশীলন হিসাবে গণিত সমস্ত সঠিক জ্ঞানের একমাত্র চাবিকাঠি নয়।
তাহলে কী এই ‘অনুশীলন?’ মাওয়ের চিন্তার সূত্র ধরে বলা যায় যে, এই অনুশীলন মানুষের ইতিহাসের ভেতরেই ঘটে আর সেখানে ঘটে বলেই এই অনুশীলন বিরাজমান উৎপাদন-সম্পর্ক থেকে বিছিন্ন নয়। কিন্তু সেখানেই শেষ না। এই অনুশীলন আমাদের জ্ঞান দেয় এই অর্থে যে, প্রকৃতি, জগৎ, জীবন ইত্যাদিতে ‘বীয়িং’-এর ‘ইন্টারভেনশান’কে এবং তাদের সঙ্গে ‘বীয়িং’-এর ‘ইন্টারঅ্যাকশান’কেই এই অনুশীলন সক্রিয় করে তুলে এই বুঝিয়ে যে, সঠিক জ্ঞান মানে বিশুদ্ধ, আসমানি জ্ঞান নয়; বরঞ্চ জ্ঞান আহরণে অনুশীলন নিজেই ‘ডায়ালেকটিক্যালি’ মধ্যস্ততা করে থাকে। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ায় অনুশীলন এবং জ্ঞান উভয়েই—মার্কসের কথা ব্যবহার করে বলা যায়--“বস্তুজগতের ভারে ভারাক্রান্ত থাকে” এবং বস্তুজগতও অনুশীলনের মধ্যস্ততায় অর্জিত জ্ঞানের ভারে ভারাক্রান্ত থাকে।
অর্থাৎ যদি এই কথাটা বলা সম্ভব হয় যে, “যাহা নাহি দেহভাণ্ডে/তাহা নাহি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে,” তাহলে এও বলা সম্ভব যে, “যাহা নাহি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে/তাহা নাহি দেহভাণ্ডে”। অন্য কথায়, ‘বস্ত’ আর ‘ভাব’-এর মধ্যে হুট করে বিভাজন-রেখা এঁকে ফেলা যায় না (বিপ্লবী ‘ডায়ালেকটিকস’-কে ঐতিহাসিক মুহূর্তের তাপে শান দেওয়ার স্বার্থেই হেগেলের তথাকথিত ‘ভাববাদ’-এবং মার্কসের তথাকথিত ‘বস্তুবাদ’-এর পুনর্পাঠ যে জরুরি হয়ে পড়ে, সেই কথা আগেও বলেছি এবং এখনও বলি); বরঞ্চ বলতে হয় বস্তুর ‘ভাবময়তা’র এবং ভাবের বস্তকতার ‘ডায়ালেকটিকস’-এর কথা।
যেহেতু অনুশীলন ও জ্ঞান উভয়েই ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট এবং যেহেতু তারা বিরাজমান উৎপাদন-সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, সেহেতু আমাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নঃ কার অনুশীলন? কিসের অনুশীলন? কোত্থেকে আসে সেই অনুশীলন? কি কাজ করে সেই অনুশীলন? একইভাবে কার জ্ঞান? কিসের জ্ঞান? কোত্থেকে আসে সেই জ্ঞান? কি কাজ করে সেই জ্ঞান?
জানি, মাও জে দং-এর কথা পাড়লেই অনেকেই—এবং এমনকি মার্কসবাদীদের একটা দলও—তেড়ে মারতে আসে আর ‘খুনি’ ‘খুনি’ বলে চেঁচাতে থাকে। আর পশ্চিমা মুলুকে কিছু বামপন্থীর মধ্যে দেখি মাওয়ের অদ্ভুত ‘রোমানটিসাইজেশান’ এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিছক সরলীকরণ। অবশ্যই মাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তবে ঢালাও মাও-বিরোধিতায় যে দুর্দান্ত গোঁড়ামিও আছে, তাও লক্ষ্য না করে পারি না।
0 comments:
Note: Only a member of this blog may post a comment.