সুরা পান আর শেকসপিয়র পাঠ হাত ধরাধরি করে চলেছে এক সময়। এখনও চলে। মনে পড়ে শিবনাথ শাস্ত্রী তার _রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ_ নামের বইয়ে উ...

নান্দনিকতার অর্থ

1:26 PM Editor 0 Comments

সুরা পান আর শেকসপিয়র পাঠ হাত ধরাধরি করে চলেছে এক সময়। এখনও চলে।
মনে পড়ে শিবনাথ শাস্ত্রী তার _রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ_ নামের বইয়ে উনিশ শতকের একদল বাঙালি তরুণের রঙ-মাখা সঙ-সাজা জীবনের একটা খণ্ডচিত্র হাজির করেছিলেন। তখন বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের পোয়াবারো। শিবনাথ শাস্ত্রীর বয়ান মোতাবেক সুরা পান করাকে এবং তার সঙ্গে শেকসপিয়র আউড়ানোকে দারুণ ব্যাপার মনে করত ওইসব তরুণ। শেকসপিয়রের একেকটি লাইন উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যেন তারা একেকটি রাজ্য জয় করতো (সুরা ও শেকসপিয়র মানেই যে একেবারে খারাপ বা প্রতিক্রিয়াশীল বা উপনিবেশবাদী পদার্থ, তা কিন্তু বুঝাতে চাচ্ছিনা, কিন্তু কী করে ওই সুরা ও শেকসপিয়র আধিপত্যবাদী ক্ষমতা-সম্পর্কের “কনফিগারেশন”-এ কাজ করতে থাকে, সেটা দেখানো দরকার বলে আমি মনে করি)।

হ্যাঁ, সুরা ও শেকসপিয়র অবশ্যই তাদের কাছে কেবল অনুপ্রাসের বিষয় ছিল না; সেগুলো ছিল শ্রেণী-অবস্থান ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে, রুচি ও আভিজাত্য নিয়ে তাদের অহংকারের বিষয় এবং সেগুলো ছিল বাংলাদেশের “নোংরা” আমজনতার প্যাচপেচে শীর্ণ দেহের সাক্ষাৎ বিপরীত।

আরেক স্পেসে, খানিকটা সুরা ও শেকসপিয়রের পথ ধরে, এক ধরনের আত্ম-সচেতন কিন্তু নকলবাগিশ ভঙ্গি তৈরি হচ্ছিল (প্রভাবিত হওয়া মানেই যে খারাপ বা “জাত-যাওয়া” ব্যাপার তা তো নয়; কিন্তু কোন্ প্রভাব কোন্ প্রসঙ্গে কি কাজ করে সেটা দেখা দরকার)। তো, সেই নকলসবাগিশ ভঙ্গিটা তৈরি হচ্ছিল খোদ সাহিত্যের এলাকায়। এই ভঙ্গির বিভিন্ন আলামত লক্ষ্য করা যায় সাহিত্যিক আধুনিকতাবাদেই। শুধু পশ্চিমাই নয়, পশ্চিমা ও ইউরোপকেন্দ্রিক নন্দনতত্ত্বের রমরমা আধিপত্যকে স্বেচ্ছায় স্থানীয় মর্যাদা ও বৈধতা দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল ওই ‘তিরিশি’ আধুনিকতাবাদের একটা বিশেষ ভার্সনের সুবাদেই; যেন এমনি একটা মন্ত্র কাজ করে যাচ্ছিলঃ কবিতার জন্য চাই বোদলেয়র ও ব্রথেল।

অবশ্যই আধুনিকতা মানে কেবল এক জিনিশ নয়, কেবল বোদলেয়র ও ব্রথেল নয়; কিন্তু তাদের সহাবস্থানের ‘নান্দনিক’ উদযাপন কেবল খামখেয়ালিপনা বা নিছক নিরীক্ষার ব্যাপার ছিল না। বরঞ্চ এর তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফলকে এখনও আমরা লক্ষ্য করে চলেছি। এবং তার একটা তাৎক্ষণিক প্রভাবের কথা এভাবে বলা যায়ঃ সেই সময় গ্রাম-ভরা ঢাকা বা কলকাতা শহর লন্ডন বা প্যারিসের মতো মেট্রোপলিটন মহানগরী না হলেও ওই ঢাকা বা কোলকাতার বাসিন্দা হয়েই একেবারে ভিনদেশি কায়দায় “মহানাগরিক” হওয়ার খায়েশ কাজ করেছে।

সোজা কথায়ঃ দেহটা কলকাতায়, কিন্তু মানসিক নোঙ্গরটা একেবারেই প্যারিসে--আহ, ঝলমলে প্যারিস নগরী! আইফেল টাওয়ার, জমে-ওঠা আর্ট গ্যালারি, বোহেমিয়ান বোদলেয়র, কিংবা তর্কের ঝড়-তোলা, শিল্প-বয়ানে-ভরপুর, কফির গন্ধ-মৌ-মৌ-করা ক্যাফে, কিংবা নাগরিক জীবনের বিবমিষা-ভরা বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি দৃশ্যকল্প বা অনুষঙ্গ ঘুরঘুর করতে থাকে কবির মনের অলিগলিতে (বা রাজপথে)।

নান্দনিকতার অর্থও তৈরি হতে থাকে ; যেমন নান্দনিকতা থাকে সেই দূরত্বে, যে দূরত্বে ভাবের সঙ্গে বস্তুর এবং মনের সঙ্গে দেহের বিভাজনটা জোর করেই তৈরি করা হয়।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.