১ দার্শনিক মার্টিন হাইডিগার স্থান-সংক্রান্ত ভাবনাকে খানিকটা টেনে বলা যায় : সত্তার সত্যকে চিহ্ন দিয়ে ঝলকিয়ে তোলে স্থান। সত্তার সত্য উ...

একগুচ্ছ 'দর্শনাখ্যান' || আজফার হোসেন

9:49 AM Editor 0 Comments


দার্শনিক মার্টিন হাইডিগার স্থান-সংক্রান্ত ভাবনাকে খানিকটা টেনে বলা যায় : সত্তার সত্যকে চিহ্ন দিয়ে ঝলকিয়ে তোলে স্থান। সত্তার সত্য উদ্ঘাটিত হওয়ার জায়গা হচ্ছে স্থান।
কিন্তু কী এই স্থান? শুধুই স্পেস? স্থান নিজেই স্পেস বটে, কিন্তু সমস্ত স্পেস আবার স্থান নয়। স্পেস দিয়ে স্থান তৈরি করা হয়। তাই স্পেস বাদে কোনো স্থান নেই।
স্থান বস্তুক। কর্তাসত্তার প্রতিদিনের পুনরুত্পাদন ঘটে স্থানেই। সেখানে সে থাকে, বসবাস করে, তার কাজে সে নিয়োজিত হয়, সেখানেই সে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। স্থানে থেকেই সে তার স্থানের অর্থ খোঁজে। যখন বলা হয়‘আপনার বাড়ি কোথায়?’ তখন ওই প্রশ্নটা আসলে স্থানের সঙ্গে কর্তাসত্তার সম্পর্ক নিয়েই জিজ্ঞাসা হাজির করে আমাদের সামনে।
‘সামনে-পেছনে’ কিংবা‘ডানে-বাঁয়ে’ কিংবা‘উত্তরে-দক্ষিণে’ চিহ্ন সব স্থানের জ্যামিতিকতাকেই নির্দেশ করে। জ্যামিতিকে যদি স্পেসের বিশেষ অঙ্ক হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তাহলে তাকে স্থানেরও বিশেষ অঙ্ক হিসেবে দেখা চলে; যদিও জ্যামিতির স্থান আরো বড়, আর স্থানের জ্যামিতি স্থানকে ভেঙে ভেঙে বোঝার বিশেষ কৌশল।‘আমিন’ যখন জমি মাপে, তখন সে স্থানেরই জ্যামিতি কষে।
স্পেস শূন্য হতে পারে, তবে স্থান‘পূর্ণ’। অর্থাত্ স্থান হয়ে ওঠে স্থান তখনই, যখন মানুষ তাকে সৃষ্টি করে, যখন মানুষ সেখানে বসবাস শুরু করে, যখন মানুষ তার পুনরুত্পাদনে নিজেকে দিনের পর দিন হাজির রাখে। মানুষ স্থান বদলায়, স্থানকে বদলায়, এমনকি স্থানকে ধ্বংসও করে।
স্পেস ও সময়ের মতোই স্থান সামাজিকভাবে গঠিত হয়। স্থান শুধুই থাকে না, স্থান হয়ে উঠতে থাকে। অর্থাত্ স্থান ক্ষেত্রবিশেষে‘বিয়িং’ এবং ক্ষেত্রবিশেষে‘বিকামিং’। অর্থাত্ স্থান একই সঙ্গে প্রক্রিয়া এবং প্রক্রিয়ার ফলাফল। স্থানেই মানুষ তার প্রতিদিনের অনুশীলন অব্যাহত রাখে। আর এভাবে মানুষ স্থানের সঙ্গে তার নির্দিষ্ট সম্পর্কের নিরিখে নিজের অর্থ ও সংজ্ঞা তৈরি করে কিংবা বদলাতে থাকে। আর এভাবে স্থান মানুষকে বদলায় যেমনি, মানুষও তেমনি স্থানকে বদলায়।
মানুষ স্থানের নাম দেয়, স্থানও মানুষের নাম দেয়।
স্থান হারিয়ে ফেলার অর্থ হচ্ছে পরিচয় হারিয়ে ফেলা। পরিচয় হারিয়ে ফেলার অর্থ আবার স্থান হারিয়ে ফেলা।
স্থানের পদার্থবিজ্ঞানী ব্রুয়েগম্যানের কিছু ধারণার পথ ধরে বলা যায়, স্থান হচ্ছে সেই স্পেস, যার ঐতিহাসিক অর্থ ইতিহাসের ভেতরেই জমা হতে থাকে। স্থান হচ্ছে সেই স্পেস, যেখানে ঘটনা ঘটে, সেই স্পেস যেখানে ঘটে-যাওয়া ঘটনার স্মৃতি জমা হয়, সেই স্পেস যেখানে স্মৃতি আর ইতিহাসের ছন্দঃস্পন্দে স্থানের ধারাবাহিকতা তৈরি হয়। স্থান হচ্ছে সেই স্পেস যেখানে হরফের ওপর রক্ত পড়ে টুপটাপ, যেখানে বিভিন্ন বয়ান আর আখ্যান জীবনের মহাকাব্যে জড়ো হয়, যেখানে মানুষের মৃত্যু সত্ত্বেও তার জীবন্ত চিহ্নসব ভেসে বেড়ায়, যেখানে মানুষের লড়াই হয়ে ওঠে তার প্রাত্যহিক জীবনের ভাষা, যেখানে প্রেম আর বিদ্রোহ হাত ধরাধরি করে চলে।
১০
স্থান লিখিত হয় ইতিহাসে। ইতিহাস লিখিত হয় স্থানে।
১১
স্থান সময়কে তর্জমা করে নির্দিষ্ট দৃশ্যে কিংবা চিহ্নে। এমনকি স্থান সময়কে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করতে চায়। আর ইতিহাস শুধু সময়কে নিয়ে নয়, স্থানকে নিয়েও।
১২
স্থান নিয়ে কথা বলা মানেই তার নামধাম, ঠিকানা, চেহারা, চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, স্থানাঙ্ক আর মানচিত্র নিয়েও কথা বলা। ভূগোলবিদ, ভূতাত্ত্বিক, জ্যামিতিবিদ, মানচিত্রকার, স্থানভাষ্যকার, নকশা-আঁকিয়ে, জ্যোর্তিবিজ্ঞানী, নগর-পরিকল্পক, নগরায়ণ সমাজতাত্ত্বিক, প্রকৌশলী, এমনকি ভাষাবিজ্ঞানী, অন্দর-নকশাবিদ, মঞ্চ-ব্যবস্থাপক, স্থপতি, সামরিক কৌশলী, গেরিলা যোদ্ধা, পরিবেশবিজ্ঞানী, ধর্মতাত্ত্বিক, সৃষ্টিতাত্ত্বিক, আমিন, গল্পকার সবাই—তাদের পথের ভিন্নতা সত্ত্বেও—কোনো না কোনোভাবে স্থানকে গুরুত্ব দেয়, পরখ করে, বয়ানে চিহ্নিত করে, হতে পারে সে স্থান একেবারে সাক্ষাত্ বাস্তব কিংবা কল্পিত, বস্তুক কিংবা রূপকার্থিক।
১৩
প্রায় প্রতিটি গল্পই ভ্রমণ গল্প—স্থান থেকে স্থানে যাওয়ার গল্প—স্থানিক অনুশীলনও—এমনই একটা কথা বলেছিলেন ফরাসি তাত্ত্বিক মিশেল দ্য স্যর্তো, যিনি স্থান আর স্থানান্তরের‘মাইক্রো-ক্যালকুলাস্’ নিয়েও তত্ত্ব ফেঁদেছিলেন। স্যর্তোর ইঙ্গিতকে সম্প্রসারিত করে বলা চলে, যে স্থানের নির্দিষ্ট গল্প আছে যেমন, তেমনি গল্পেও নির্দিষ্ট স্থান আছে। এবং স্থান ছাড়া গল্প নেই। এই স্থান হতে পারে বাস্তব কিংবা কল্পিত, পুরনো কিংবা নতুন, বড় কিংবা ছোট।
১৪
বিশ্বে যতটা না স্থান আছে তার চেয়ে বেশি আছে তা বিশ্বসাহিত্যে।
১৫
মহাকাব্যের প্রসঙ্গ আনা যাক। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মহাকাব্য‘গিলগামেশ’ কিংবা ভারতের মহাকাব্য‘রামায়ণ’‘মহাভারত’ কিংবা জাপানি সামরিক মহাকাব্য‘হাইকানামা’ কিংবা মধুসূদন দত্তের‘মেঘনাদবধ কাব্য’ অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার কবি মাজজিসি কুনেনের জুলু মহাকাব্য‘সম্রাট শাকা’ বিভিন্নভাবে স্থানকে ব্যবহার করেছে—কখনো পটভূমি, কখনো প্রস্থানভূমি, কখনো পরিপ্রেক্ষিত, কখনো বিষয়, কখনো এমনকি চরিত্র হিসেবেও। স্থান নির্মাণের ও ভাঙনের এবং স্থান দখলের গল্প এবং চিত্র বিভিন্ন মহাকাব্যে বিভিন্নভাবে উপস্থিত। এমনকি মহাকাব্যিক স্থান—কল্পিত কিংবা সাক্ষাত্ কিংবা ঐতিহাসিক—মহাকাব্যের নায়ককে চরিত্রায়িত করে। অন্যভাবে বলা যায়, মহাকাব্যের নায়ককে চেনা যায় স্থানের সঙ্গে তার নির্দিষ্ট সম্পর্কের নিরিখে। মহাকাব্যের এই নায়ক যুদ্ধ করে, স্থান দখল করে কিংবা স্থানের পতন ঘটায় কিংবা এমনকি হারানো স্থানকে আবার উদ্ধারও করে অথবা নিজের বা অপরের স্থানকে বদলাতেও থাকে। স্থান ছাড়া মহাকাব্যের নায়কের কোনো সাক্ষাত্ লিপ্ততা বা তত্পরতা নেই।
১৬
ইতালীয় কবি দান্তের মহাকাব্য ‘ডিভাইন কমেডি’ থেকে তার বিচিত্র স্থান যদি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে মহাকাব্যটি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে বাধ্য। কবি নিজেই যে অনুপ্রাণিত নকশাবিদ কিংবা নিরূপক হয়ে ওঠেন, তার প্রমাণ‘ডিভাইন কমেডি’র দান্তে নিজেই। এই মহাকাব্য নান্দনিকতার সঙ্গে গাণিতিকতার, গাণিতিকতার সঙ্গে ভৌগোলিকতার, ভৌগোলিকতার সঙ্গে স্থাপত্যবিদ্যার অভূতপূর্ব যোগসাজশে স্থান নির্মাণের প্রক্রিয়া জারি রেখেছে দোজখ থেকে বেহেশত পর্যন্ত। আর মহাকাব্যিক অভিযাত্রা মানেই স্থান থেকে স্থানে যাত্রা।
১৭
রূপকথায় আর উপকথায় কিংবা কিংবদন্তিতে কিংবা নীতিগল্পে বিভিন্ন মাত্রায় স্থানের ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়।‘আরব্য রজনী’র কথাই ধরা যাক।‘আরব্য রজনী’র প্রতিটি গল্পময় রাত শুধু সময়েই নয়, স্থানেরও। সেই স্থান আরব দেশীয়। আর যাকে আরব দেশীয় গল্প বলা হয়, তা বিশুদ্ধ আরব্য নয়, কেননা সেখানে থাকে পারস্য আর ভারত। মৃত্যুকে না-বলা গল্পকার শাহেরজাদের প্রায় প্রতিটি গল্পেই স্থান আছে এবং স্থানান্তর আছে। গল্পের গতি ও প্রবহকে নিয়ন্ত্রণ করে স্থান; আবার সেই গতি ও প্রবহ স্থানকেও পাল্টা নিয়ন্ত্রণ করে। স্থান নিজেই যেমন গল্প তৈরি করে, তেমনি গল্পও তৈরি করে স্থান।
১৮
যাকে ‘উপন্যাস’ নামে আমরা ডেকে থাকি, তার স্থাপত্যনীতির অন্যতম ভিত্তিভূমি হচ্ছে স্থান। মার্ক্সবাদী ভূবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ডেভিড হার্ভির একটা কথাকে খানিকটা টেনে এভাবে বলা যায়, স্থানের ও সময়ের সূচকের সমবায়ে উপন্যাসের একটি নির্দিষ্ট সমগ্র মূর্ত হয় এমনভাবে যে, সময় নিজেই তার দেহ লাভ করে কিংবা নান্দনিকভাবেই সময় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আর অন্যদিকে সময়, প্লট ও ইতিহাসের গতিকে ধারণ করে স্থান ভরে ওঠে, প্রাণ পায়। এভাবেই মানবিক ভূগোলশাস্ত্রে স্থান পরিগঠিত হয়।
১৯
যাকে‘নগর’ বলি, তা আসলে প্রথমেই স্থান। অথবা নগর হচ্ছে বিভিন্ন স্থানের গতিশীল সমগ্র। আর গল্পরা স্থানকে জড়ায়, বানায়, সংগঠিত করে, নির্বাচিত করে, এমনকি ভাঙেও। গল্পরা স্থানকে মূর্ত করে কিংবা ভুতুড়ে করে। জেমস জয়েসের ডাবলিন কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঢাকা—তাদের ভিন্ন চেহারা ও চরিত্র সত্ত্বেও—কখনো জাহিরি বা সাক্ষাত্ বাস্তব, কখনো কাল্পনিক, কখনো ঐতিহাসিক, আবার কখনোবা পুনর্নিমিত। আবার বিভিন্ন চিহ্নে, দৃশ্যে, কর্তাসত্তায় সেই ঢাকা বা ডাবলিন ভাষায় উদ্ভাসিত। আর এই ঢাকা ও ডাবলিনের স্থানিক অনুপুঙ্খে প্রাত্যহিকতা তার নাম লেখে—এমনকি ঘোষণাও করে। যেখানে ঢাকা নেই, ডাবলিন নেই, সেখানে ইলিয়াসের আর জয়েসের চরিত্র নেই। এমনকি ঢাকা আর ডাবলিন মাঝেমধ্যে চরিত্রও হয়ে ওঠে। জয়েসে আর ইলিয়াসে স্থান চরিত্রের কথা বলে আর চরিত্র স্থানের কথা বলে।
২০
স্থানও ভাষা হয়ে উঠতে পারে।
২১
কোনো কোনো কবির জন্য স্থান হয়ে ওঠে রূপক আর রূপক হয়ে ওঠে স্থান। এখানে জীবনানন্দ দাশের কথা বলতে হয়। তাঁর কবিতায় রূপক আর স্থানের স্থান বদলাবদলি দেখা যায়। এমনকি দেখা যায় স্থানের ভেতরে স্থান। জীবনানন্দের‘বনলতা সেন’ ভৌগোলিক ও স্থানিক কল্পনার কবিতা। কবিতার প্রথম স্তবকেই চিহ্নের প্রবহে ঝলকে ওঠে স্থান : সিংহল আর রাতের অন্ধকারে মালয়; বিম্বিসার আর অশোকের ধূসর স্পেস; এবং দূর নগরী বিদর্ভ। আর থাকে নাটোর—সেই স্থান যেখানে বনলতা থাকে, আবার থাকেও না। কবিতার অল্প স্পেসেই মহাকাব্যিকতাও আছে। আছে স্থান থেকে স্থানের মহাকাব্যিক আয়তনের অভিযাত্রা। কিন্তু এসব স্থান আবার রূপকেরও চেহারা নেয়। হাজার-বছর-ধরে-হাঁটা অভিযাত্রীর বিভিন্ন মুড ও মেজাজের এবং এমনকি অভিজ্ঞতার রূপক হয়ে ওঠে স্থান নিজেই। বনলতা সেনের‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’ প্রশ্নটা একই সঙ্গে সময় ও স্থানের প্রশ্ন। অন্যদিকে‘পাখির নীড়’ স্থান হয়েও রূপক হিসেবে কাজ করে। এই রূপকের স্পেসে‘চিহ্নায়ক’ ও‘চিহ্নিত’ যেন একই বিন্দুতে মিলতে চায়। বনলতা এখানে একজন নির্দিষ্ট স্থানিক কর্তাসত্তা যেমন, তেমনি সে শান্তির আবাসেরও রূপক। আসলে জীবনানন্দ দাশ তাঁর কাজের সমগ্রে মানচিত্রল কল্পনায় স্থানকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছেন। আর তাকে ব্যবহার করেছেন এমনভাবে যে তাঁর কবিতায় স্থান নিজেই ভাষা হয়ে ওঠে।
২২
চিহ্নে-চিহ্নে আর স্মৃতিতে-স্মৃতিতে খেলা করে স্থান।
২৩
অস্তিত্বের প্রকৃতিকে নির্দেশ করে স্থান। কর্তাসত্তাকে ভিত্তিভূমি দেয় এবং এমনকি তাকে সংজ্ঞায়িতও করে স্থান। একজন শুধু হয় না; সে হয়ে ওঠে। একইভাবে স্থান শুধু হয় না; স্থান হয়ে ওঠে। এই হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় স্থান আর কর্তাসত্তা উভয়েই পরস্পরকে একটা বহমান সম্পর্কে জড়িয়ে রাখে।
২৪
স্থান কেবল বিশেষ্য নয়, স্থান ক্রিয়াও। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষণও। লাতিন আমেরিকার ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর মহাকাব্যিক আয়তনের উপন্যাস‘শত বছরের নির্জনতা’য় মাকোন্দো নামের এক কাল্পনিক শহরকে প্রথমত স্থান হিসেবেই উপস্থিত করেন। এই স্থান কোনো স্থির স্পেস নয়। মাকোন্দো তার অন্তর্গত ছন্দঃস্পন্দে এবং বাইরের ঘটনা ও অবস্থার চাপে ও তাপে বদলাতে থাকে। যা ছিল না মাকোন্দো, তাই হয়ে ওঠে মাকোন্দো। গাণিতিক রূপক ব্যবহার করে বলা চলে, এমনকি মাকোন্দোর যোগ চিহ্ন রূপান্তরিত হয় তার বিয়োগ চিহ্নে। শহর বা স্থান হিসেবে মাকোন্দো তার নিজস্ব কিন্তু বদলাতে-থাকা গুণাগুণকে প্রকাশ করতে থাকে। মাকোন্দো তার বসবাসকারীদের বিভিন্ন অনুশীলনের সমগ্র হয়ে ওঠে; এমনকি বিভিন্ন অনুশীলনের গুণাগুণকে সে চিহ্নিত করতে থাকে একের পর এক। অন্যদিকে স্থান বা শহর হিসেবে মাকোন্দো তার গল্প বলে যেমন, তেমনি সে আবার বিভিন্ন কিসিমের গল্পকে টেনে আনে এবং একসঙ্গে জড়ো করে। মহাকাব্যিক উপন্যাসের ভেতরে মাকোন্দো হয়ে ওঠে গল্পময়। এমনকি গল্প-বলিয়েও। যেখানে মাকোন্দো নেই, সেখানে গল্পও নেই।
২৫
স্থান সত্তাতাত্ত্বিক যেমন, তেমনি সে জ্ঞানতাত্ত্বিকও। স্থান দিয়ে মানুষ জানতে পারে সে কোথায় আছে। স্থান হয়ে ওঠে জ্ঞানের উত্পাদকও। স্থান আবার অবস্থানও। সে কারণে স্থানই জানিয়ে দেয় কার স্থান কোথায়। স্থান নির্ণয়ের বিষয়টি সরাসরি জ্ঞানোত্পাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত। যাকে শ্রেণিবিন্যাস বলা হয়, তা স্থানবিন্যাসও। এই স্থানবিন্যাস বিভিন্নভাবেই জ্ঞান অর্জনের উপায় হিসেবে কাজ করতে পারে।
২৬
স্থান রাজনৈতিক। বিভিন্নভাবেই রাজনৈতিক। যখন কোনো স্থানকে নাম দিয়ে ডাকা হয়, তখন সেই স্থানকে একই সঙ্গে চিহ্নিত করা হয়, শনাক্ত করা হয়, অন্য স্থান থেকে তাকে আলাদা করা হয়, তাকে এমনকি নির্দিষ্ট স্পেস ধার্য করে ন্যায্যতা দেওয়া এবং এভাবে স্থান নির্দিষ্ট ক্ষমতা-সম্পর্কে জড়িত হয়, এমনকি নিজের ক্ষমতাও প্রয়োগ করতে থাকে।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.