ভালটার বেনজামিন: একটি সংক্ষিপ্ত নোট || আজফার হোসেন
ভালটার বেনজামিন: একটি সংক্ষিপ্ত নোট
বোদলেয়র, কাফকা ও প্রুস্তের দুর্দান্ত পাঠ হাজির করেছিলেন জর্মন মার্কসবাদী সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক ভালটার বেনজামিন। তাঁর সেই বোদলেয়র পাঠ নিজেই তো অনন্ত পাঠযোগ্য। এখানে বিশেষ করে বলতে হয় বেনজামিনের কাজ ‘অন সাম মোটিফস ইন বোদলেয়র’ (১৯৩৯)-এর কথা। এই কাজে তিনি বিশেষ করে তিনটি বিষয়ে--শ্রেণী, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি বিষয়ে--তাঁর ধারণাকে উপস্থিত করেছেন। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিবাদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের তীব্র সমালোচনা করতে গিয়েই এসব ধারণাকে তিনি সামনে এনেছেন এবং বেনজামিনের বোদলেয়র পাঠে আমরা লক্ষ্য করি ফ্রয়েড ও লুডভিগ ক্লাগেসের ফ্যাসিবাদী নৃ-তত্ত্বের কিছু কৌশলের পাল্টা প্রয়োগ।
বস্তুক ও আধ্যাত্মিক ইডিয়মের রসায়নই বেনজামিনকে টেনেছে বোদলেয়রের দিকে। ধারণাটি যথার্থ দিয়েছেন আমাদের কমরেড রিচার্ড কার্নি। তবে বিশেষভাবে দেখতে হয় যে, বোদলেয়রের কবিতায় বেনজামিন দেখেছেন সেই ভবঘুরে প্রবণতাকে, যার উপস্থিতি সম্ভব কেবল বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে, পশ্চিমা মুলুকের পুঁজিবাদের জমে- ওঠা পর্যাযে। এই ভবঘুরে--বা বোদলেয়রের যাযাবর--যে অভাবনীয পথ-পরিক্রমা রচনা করে, তা বন্ধ আর্কেডকে ভেঙে দিয়ে উন্মুক্ত, প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করেছে। বেনজামিনের বিবেচনায়, বোদলেয়রের ভবঘুরে সত্তা যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, সে রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট নেই, বরং আছে বৃক্ষশ্রেণী। এভাবে বেনজামিন তাঁর বোদলেয়রকে দাঁড় করাচ্ছেন পুঁজিবাদ-প্রভাবিত বদ্ধ নগরায়নের বিরুদ্ধে।
বোদলেয়রের নগর-দর্শনকে বেনজামিন গভীর মনোযোগসহকারে পাঠ করেছেন। প্যারিসের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অর্থ ঘড়ির কাঁটা ধরে প্রগতি কিংবা গতিকে নির্ণয় করা নয়, বরং সেই অর্থকে বোঝা বা চালনা করা, যা কেবল স্পেসেই নির্ণয়যোগ্য। বেনজামিনের বিবেচনায় পুঁজিবাদী-বুর্জোয়া মতাদর্শ সময়ের রৈখিক ক্রমকে সমাদর করে, কিন্তু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ প্রশ্রয় দেয় স্পেসের অরৈখিকতাকে, যেখানে স্পেসেই শ্রেণী সংগ্রামের অনুপুঙ্খকে প্রত্যক্ষ করা যায়। বোদলেয়র ‘সময়’ এর কবি নন, বরং ‘স্পেস’-এর কবি--এই ধারণাটাকে সামনে এনেই বেনজামিন বোঝাতে চেয়েছেন যে, বোদলেয়র সেই কবি যিনি উনিশ শতকের ফরাসি বুর্জোয়া মতাদর্শকে, বুর্জোয়া স্থিতি ও নীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। যন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়া আর ঘড়ির কাঁটা দিয়ে বাস্তবতাকে নিউটনীয কায়দায় মেপে মেপে পুরো স্পেসকে (শোষণের ক্ষেত্রকে) আড়াল করার বুর্জোয়া কৌশলকে বোদলেয়র নাকচ করেছেন বলেই মার্কসবাদী বেনজামিনের কাছে বোদলেয়র অনুপ্রেরণা হয়ে থাকেন, যার সুবাদে বেনজামিন বলেছিলেন বিপ্লবের 'টপোলজি'র (স্থানতত্ত্বের) কথা।
বেনজামিন যে ফটোগ্রাফির দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন, তারও একটা কারণ হচ্ছে বেনজামিনের স্পেসপ্রীতি ও বোদলেয়রপ্রীতি। ফটোগ্রাফি, বোদলেয়রের চিত্রকল্পের মতোই, সময়কে মহাকালের কাছে বলি না দিয়ে তাকে ধারণ করে স্পেসের ভেতর। অন্য কথায়, ফটোগ্রাফি সময়কে স্পেসে রূপান্তরিত করে। কিন্তু এও সত্য যে, বেনজামিনের কাছে ফটোগ্রাফি কিংবা স্পেস কোনো নির্দিষ্টবাচকতা বা একরৈখিকতা বা নিশ্চিতিকে নির্দেশ করে না; সেখানেও অর্থ ঊনপঞ্চাশটাই হতে পারে এই অর্থে যে, পাঠ তো আর থেমে থাকে না। সেও বোদলেয়রের ভবঘুরের মতোই ছুটে চলে ঊনপঞ্চাশটি পথে। অর্থাৎ স্পেস মানেই কোনো জমাটবাঁধা স্থান নয়।
বোদলেয়রের কাছ থেকে বেনজামিন যে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাটি লাভ করেন, তা হচ্ছে নগরীর অভিজ্ঞতা। বেনজামিন মনে করেন, একেকটি নগরী হচ্ছে একেকটি ‘ছোট পৃথিবী’, যেখানে ইতিহাসের অর্থগুলো বিভিন্ন বস্তুর কোলাজে ধরা পড়ে, ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও। নাগরিক প্রাত্যহিকতায় কিংবা নগরীতে সংঘটিত বড়, সাধারণ ও ক্ষুদ্র ঘটনায় বিপ্লবের ব্যঞ্জনা লুকিয়ে থাকতে পারে বলে বেনজামিন মনে করেছেন। এ কারণে তিনি মাছের বাজার কিংবা 'বেশ্যালয়' কিংবা রাস্তার ধারের জটলা কিংবা চায়ের দোকানের আলাপকে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন এবং এও দেখা গেছে যে, রেস্টুরেন্টের আড্ডা থেকে উঠে আসা কোনো ‘ক্লিশে’কে কিংবা রাস্তা থেকে তুলে আনা কোনো গুজবকে বেনজামিন রীতিমতো র্যাডিক্যাল প্রবচনে রূপান্তরিত করেছেন। এও বোদলেয়র-পাঠের ফসল বৈকি।
0 comments:
Note: Only a member of this blog may post a comment.