ভূমিহীনদের হাসি শুনে কেন যে মাঝেমধ্যে ভড়কে যাও? || আজফার হোসেন
মরে গেলে অনেক সময় মানুষ যে রাতারাতি মহামানুষও হয়ে উঠতে পারেন, তা তো আমাদের সংস্কৃতিতে কোনো অচিন বাস্তবতা নয়। কিন্তু যা সত্যি মনে করি তা তো বলতেই হবেঃ আল মাহমুদকে আগেও বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি হিসাবে বিবেচনা করেছি, এখনও করি—এবং করতেও হবে, তাঁর কবিতার গুণের কারণেই।
জানি, রাজনৈতিকভাবে তাঁর বদনাম করা সহজ। কিন্তু এও প্রমাণিত হয়ে আছে যে, তিনি আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সত্তরের দশকেই তাঁর আপসহীন হিম্মতী জবানের কারণে তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল। বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল তাঁর পত্রিকা _গণকণ্ঠ_। পরে এই কবি রাজনীতির কোন্ পথ ধরে কোন্ জায়গায় গেলেন এবং কেন গেলেন, সে আলোচনা পরে অবশ্যই হবে, কারণ অন্যদের মতই আল মাহমুদ মোটেই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন।
কিন্তু সমালোচনা মানেই তাঁর কাজের সমগ্রকে জোর করে ‘ডিসমিস’ করা নয়।
আর, না, জোর করে এইখানে তাঁকে আবার 'রাজনৈতিক’ করে তোলার খায়েশও আমার নেই। তবে কি করে অস্বীকার করা যাবে তাঁর কবিতায়-কবিতায় হরফে হরফ ঘষে জ্বালিয়ে-রাখা তাঁর প্রাণের, প্রেমের, এমনকি সংগ্রামের আগুন, যা আমাদের পরিচিত জনপদের ইতিহাসেই জ্বলতে থাকে, কেবল জ্বলতে থাকে। তাঁর অসাধারণ নান্দনিক গুণসমৃদ্ধ, অতি পরিচিত, মুখে-মুখে-ফেরা কবিতাগুলোর বাইরে গিয়েও তাঁর অন্য কিছু লাইন আজ বেশ মনে পড়ছেঃ
ধ্বংস যদি করবে তবে, শোনো, তুফান
ধ্বংস করো বিভেদকারী পরগাছাদের;
পরের শ্রমে গড়ছে যারা মস্ত দালান
বাড়তি তাদের বাহাদুরী গুঁড়িয়ে ফ্যালো।
--“বোশেখ,” __সোনালি কাবিন_
আমি তোমার দিকে এক সরল গ্রাম্য কিষাণের মত চেয়ে থাকি
কারণ আমি ভূমিহীনদের দুঃখ জানি। আসলে আমি
মেঘনাপাড়ের রাইসরিষার এক অদ্ভুত ভূমিখণ্ডের ওপর
হাল চালিয়ে একশো রকম বীজ বুনি। আকালে উষর হলে
আমি কি পারি আমার আদিম মাটিকে ছেড়ে যেতে?
ভূমিহীনদের হাসি শুনে কেন যে মাঝেমধ্যে ভড়কে যাও? আমি কি
অনন্তের বীজ হাতে নিয়ে আইলের পাশে চিরদিনের জন্য
দাঁড়িয়ে আছি না?
--“মায়াবী সালুন,” _আমি, দূরগামী_
এবারে কাশ্মীর নিয়ে আল মাহমুদের কিছু লাইনঃ
মানবিক বৃত্তির যা কিছু প্রাপনীয়, কিনে নিতে হবে রক্তের দামে।
যেমন কিনে নেয় মানুষের গুলিবিদ্ধ বুক সন্তানের স্বাধীনতা, গ্রামগুলোর সম্ভ্রম।
ভূস্বর্গে আগুন জ্বলছে। আর আমাকে কে যেন চোখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে
বধ্যভূমির দিকে--
তবুও কি অদম্য মানুষের স্বাধীনতার গান।
স্বাধীনতা শব্দটি পারতপক্ষে এখন আর উচ্চার্য নয়।
স্বাধীনতা, এক উপত্যকাবাসীর ফিনকি দেয়া চিৎকার। লেকের ভেতর
প্রতিটি নৌকোয় এখন গুঞ্জরিত হচ্ছে কাশ্মীর। মনে হয় প্রতিটি বিষণ্ণ মুখই
উদ্গীরণ করতে পারে বুলেট।
প্রতিটি যুবতীর বক্ষসুষমায় লুকিয়ে আছে বিস্ফোরক।
প্রতিটি কিশোরীর ইজ্জতের ওপর এখন রোপিত আছে স্বাধীনতার পতাকা।
অত্যাচারীর প্রতিটি রোমকূপ এখন আজাদীর রক্তে সিক্ত। স্বাধীনতা এখন
হাত বাড়িয়ে দেওয়া ইতিহাস কিংবা
ইতিহাস এখন অপেক্ষমাণ কাশ্মীর।
--“উপমহাদেশ, কাশ্মীরঃ ’৯৩,” _আমি, দূরগামী_
0 comments:
Note: Only a member of this blog may post a comment.