গ্রামসির বিরাজনীতিকীকরণ || আজফার হোসেন
রঙ-মেখে সঙ-সাজা সাদা সংস্কৃতি-তাত্ত্বিকদের একটা দল—এদের মধ্যে আবার উত্তরঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকদের কেউ কেউ আছেন—গ্রামসি কপচাতে যে বেশ ভালবাসেন, তার সাক্ষী নিদেন পক্ষে দুই দশকেরও বেশি সময়ের ইতিহাস।
কথায় কথায় এরা গ্রামসির বরাতে ‘হেজিমনি’ ‘হেজিমনি’ বলে মুখে ফেনা তুলতে থাকেন। এদের ভাবটা এমন যে, গ্রামসির দৌড় যেন তার ‘হেজিমনি’ তত্ত্ব পর্যন্ত!
আর তাছাড়া এরা গ্রামসির ‘মার্কসবাদী’ পরিচয়টাকে সুকৌশলে এড়িয়ে যান। গ্রামসি যে দুর্ধর্ষ কম্যুনিস্ট ছিলেন এবং এমনকি ইতালির কম্যুনিস্ট পার্টির একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং পার্টির শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবী নেতা ছিলেন, এইসব ঐতিহাসিক সত্য বেমালুম চেপে যান ওই সংস্কৃতি-ফুটানো, ফুটানি-মারা, গ্রামসি-কপচানো তাত্ত্বিকরা।
অবশ্য গ্রামসির বিমার্কসীয়করণের রেওয়াজ এর মধ্যে ‘উত্তরকাঠামোবাদ’-প্রভাবিত ‘উত্তরমার্কসবাদী’ তত্ত্বের কিছু এলাকা জুড়েও লক্ষ্য করা গেছে। এই বিমার্কসীয়করণের সঙ্গে গ্রামসিকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টা সরাসরি যুক্ত। সেখানেই শেষ নয়। গ্রামসিকে এমনকি ‘উত্তরাধুনিকতাবাদী’ এবং ‘উত্তরঔপনিবেশিক’ তাত্ত্বিক হিসাবে হাজির করার উৎসাহে আর উল্লাসে গ্রামসির বিপ্লবী কম্যুনিস্ট রাজনীতিকেও ধোঁয়াশা করা হয়েছে বারবার।
তবে হাল আমলে পশ্চিমা মুলুকেই গ্রামসির এই বিমার্কসীয়করণের এবং এমনকি বিরাজনীতিকীকরণের দৃষ্টান্তমূলক এবং মোক্ষম জবাব দিয়ে চলেছেন একদল তরুণ মার্কসবাদী তাত্ত্বিক-অ্যাক্টিভিস্ট। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন পিটার টমাস (না বলে পারছি না যে, তিনি আমার কমরেডও)। তার সাম্প্রতিক সাড়া-জাগানো বইয়ের নাম _দ্য গ্রামসিয়ান মোমেন্ট_। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার পাশাপাশি তিনি তার বইটিতে বৈপ্লবিক মার্কসবাদী ঐতিহ্যেই গ্রামসিকে নতুনভাবে উপস্থিত করেছেন এবং গ্রামসিকে নিয়ে পশ্চিমা মুলুকের সংস্কৃতি-তাত্ত্বিকদের—এবং উত্তরআধুকিকতাবাদী-উত্তরঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকদের—প্রতিক্রিয়াশীল এবং সংস্কৃতিবাদী ধুনফুনেরও জবাব দিয়েছে্ন। এই বইটা নিয়ে অবশ্য এর আগে আমি ফেসবুকে নোট দিয়েছি একাধিকবারই।
তো, ফিরে আসি গ্রামসির ‘হেজিমনি’ তত্ত্ব প্রসঙ্গে। আগেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, গ্রামসি মানেই কেবল এই তত্ত্ব নয়, যদিও গ্রামসির কাজে এই তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়েই থাকে। কিন্তু ওইসব তাত্ত্বিক এই ‘হেজিমনি’ তত্ত্বকে কেবল যে বারবার ব্যবহার করতে থাকেন তাই নয়; বরঞ্চ এই তত্ত্বটাকে তারা কেবল উপরিকাঠামোগত এবং সংস্কৃতিবাদী অর্থে যান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করতে থাকেন এমনভাবে যেন মনে হয়, রাজনৈতিক অর্থনীতির সাথে ‘হেজিমনি’র কোনো যোগাযোগ নাই, যেন সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতির কোনো যোগাযোগ নাই, যেন সংস্কৃতি একেবারে উৎপাদন-সম্পর্কের দিগন্তের বাইরেই অবস্থান করে!
সত্য, গ্রামসি মোটেই অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদী ছিলেন না; বরঞ্চ মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি আর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদকে সমার্থক ভেবে যারা এই দুইটি বিষয়কে এক করে গুলিয়ে ফেলতে অভ্যস্ত, তাদের বিরুদ্ধেই গ্রামসি জোরেশোরে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু আবার তিনি যে সংস্কৃতিবাদিতার (বা সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণবাদের) খপ্পরে পড়েছিলেন, তাও নয়। বরঞ্চ তিনি সংস্কৃতিবাদিতার বিরুদ্ধেও জোরেশোরে অবস্থান নিয়েছিলেন। এমনকি তিনি ‘হেজিমনি’কে কেবল গণসম্মতি আদায়ের মাধ্যমে মতাদর্শিক আধিপত্য বা নেতৃত্ব হিসাবে বিবেচনা করেই থেমে থাকেন নাই; বরঞ্চ তাঁর _প্রিজন নোটবুকস_-এ এও বলেছিলেন, “যদিও ‘হেজিমনি’ নৈতিক-রাজনৈতিক, তাকে অবশ্যই অর্থনৈতিকও হতে হবে; তার ভিত্তিভূমি হবে সেই চূড়ান্ত ভূমিকা যা নেতৃস্থানীয় গ্রুপ পালন করে থাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চূড়ান্ত কেন্দ্রেই” (_সিলেকশানস ফ্রম প্রিজন নোটবুকস_ ১৬১)।
অর্থনীতির—বলা ভালো, রাজনৈতিক অর্থনীতির—এই গ্রামসিকেও চিনে রাখা দরকার।
0 comments:
Note: Only a member of this blog may post a comment.