ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, এবং এমনকি তারও আগে, ইংরেজিতে কবিতা লেখার একটা বাতিক ছিল আমার। তো, রাত জেগে-জেগে কবিতা লিখতাম, আর সকাল বেলা ব...

কবিতা লেখার বাতিক ও বিড়ম্বনা || আজফার হোসেন

8:26 PM Editor 0 Comments



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, এবং এমনকি তারও আগে, ইংরেজিতে কবিতা লেখার একটা বাতিক ছিল আমার। তো, রাত জেগে-জেগে কবিতা লিখতাম, আর সকাল বেলা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমাদের ইংরেজি বিভাগের এক বোদ্ধা সতীর্থকে আমার কবিতা দেখাতাম।

আমার এই সতীর্থ আমার চেয়ে বছর ছয়েকের-কি-সাতেকের বড়ো হবেন; সে কারণে একটা মুরুব্বি-ভাবও ছিল তাঁর। সে-ভাবটা তাঁকে যে মানাতো না, তা নয়। তিনি তখন ইয়েটস-পাউন্ড-এলিয়ট গড়গড় করে মুখস্থ বলে যেতেন, নিজেও কবিতা লিখতেন, বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের ভেতরে তাঁর বেশ নামডাকও ছিলো।

এক সকালে তাঁকে যখন আমার একটা কবিতা দেখালাম, ভুরু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে তিনি জানালেন, আমার 'ইমেজ'গুলো বড্ড বেখাপ্পা, আমার ছন্দও বেখাপ্পা, আমার ইংরেজিও বেখাপ্পা। বলতেই হবে, ওই কাঁচা বয়সে বেশ আহত হয়েছিলাম তাঁর প্রতিক্রিয়ায়। কিন্তু আমি তখন মোটেই দমে যাওয়ার পাত্রও ছিলাম না। আরও উৎসাহ নিয়ে আমার আরেকটি কবিতা তাঁকে দেখালাম; সেটাও 'বেখাপ্পা' ঘোষিত হলো। তারপর রাত জেগে বেশ ঘষামাজা করার পর আরও একটা কবিতা তাঁকে দেখালাম; সেটাও 'বেখাপ্পা' ঘোষিত হলো।

এরপরও হয়ত লজ্জাশরমের মাথা খেয়েই তাঁকে আরও একটা কবিতা দেখালাম, যে কবিতাটা অবশ্য আমি টানা সাতদিন ধরে রিভাইজ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের সেই বোদ্ধা সমালোচক, সেই সিনিয়র বন্ধুটির সুরে ও স্বরে, বিবেচনায় ও ঘোষণায় সামান্যতম পরিবর্তন ঘটলো না। শুধু তাই নয়, আমার একদল স্মার্ট সহপাঠীর সামনে তিনি বলেই বসলেন, "আজফার, তোমার কবিতা কিচ্ছু হয় না।"

দারুণ অপমানিত ও লজ্জিত বোধ করেছিলাম। মনে হয়েছিলো, শালার লাইফটা একটা ফালতু জিনিশ!

কিন্তু বেশ কিছুদিন পর, এক সকালে, আমাদের ওই বোদ্ধা সতীর্থ-'বন্ধু'টি যখন ইংরেজি বিভাগের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে খোশগল্পে ব্যস্ত, তখন একটা কবিতা নিয়ে আবারও গেলাম তাঁর আছে। এবারে তিনি ওই কবিতাটা দেখতে একেবারেই নারাজ। তবে বেশ কিছুক্ষণ আমার পীড়াপীড়ির পর তিনি কবিতাটা পড়তে রাজি হলেন এবং নির্দ্বিধায় আবারও ফতোয়া দিলেন, "এটা কোনো কবিতা হয় নাই। কতোগুলো সুন্দর শব্দ তুলে দিয়ে তাদের বারোটা বাজানো হয়েছে।"

কবিতা হয় নাই?

তবে এবার আমি আহত হলাম না, বরঞ্চ আনন্দিত হলাম, যদিও সেখানে ইংরেজি বিভাগের উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ হয়তো আমাকে ততোক্ষণে একটা 'ইডিয়ট' ভাবা শুরু করেছে।

ঠিক পরের সকালে আবারও গেলাম আমাদের সেই সমালোচক-বন্ধুটির কাছে। সেদিনও প্রায়-একইভাবে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী তাঁকে ঘিরে রেখেছে। আমি তাঁকে বললাম, "নেরুদার এই কবিতাটা দেখেছেন, ভাই? সেদিন একটা সংকলন থেকে কবিতাটা টুকে রেখেছি; কারণ এইটা নেরুদার তুলনামূলকভাবে অপরিচিত কবিতা।" সেকি উৎসাহ তাঁর! সেকি কবিতা-প্রেম তাঁর! মুহূর্তেই তিনি আমার হাত থেকে কবিতাটা লুফে নিলেন। উপদেশও দিলেন তিনিঃ "হ্যাঁ, হ্যাঁ, নেরুদা পড়বে। ভালো ভালো কবিতা পড়বে। অডেন পড়বে। ডিলান টমাস পড়বে।" আনন্দে আমি মাথা নাড়লাম।

এরপর তিনি জোরে-জোরে আমাদের সকলের সামনে কবিতাটা পাঠ করা শুরু করলেন; প্রতিটা লাইন পাঠ করেন, আর বলেন, "কী চমৎকার!" আমি আবারও আনন্দিত হলাম। তিনি তখন ওইসব ছাত্রছাত্রীকে বোঝাতে শুরু করলেন কবিতাটা কেনো ভালো, কোথায় তার শক্তি, কোথায় তার ইমেজের প্রাখর্য্য আর উপমার চমক, কিংবা অর্থের গভীরতা।

আমার আনন্দ আর ধরে না। মনে হলো, একটা চমৎকার সকাল যেনো ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন কেবল আমারই জন্য!

এবার হাজির হলো আমার ঘোষণা দেওয়ার পালা। বললাম, "ভাই, আপনি যে কবিতাটা পড়ে প্রশংসা করলেন, সেই কবিতাটা নেরুদার নয়। সেইটা আসলে আমার। আমার এই কবিতাটা নীলক্ষেতে গিয়ে টাইপ করিয়ে নিয়ে সেখানে আমার নাম না বসিয়ে নেরুদার নাম বসিয়ে দিয়েছি। আর গতকাল যে-কবিতাটা আপনি ডিসমিস্ করেছেন, সেটি আসলেই ছিল নেরুদার। সেখানে নেরুদার নামের বদলে আমার নাম বসিয়ে দিয়েছিলাম।"

এই বলে আমার থলি থেকে নেরুদার কবিতার সংকলন বের করে প্রমাণ হিসাবে তাঁকে দেখালাম। সঙ্গে-সঙ্গেই তুমুল জমে-উঠা সমালোচনার উৎসবটি চুপসে গেলো। এখন মনে হয়, এই সবই ছিল সেই অল্প বয়সের পাগলামি!

কিন্তু লক্ষ্য করলাম, আমাদের বোদ্ধা সমালোচক সতীর্থ-বন্ধুটি হতভম্ব হয়ে পড়েছেন। হ্যাঁ, 'বেখাপ্পা' অবস্থাই বটে। তিনি যে খুব কষ্ট পেয়েছেন, সেটাও বুঝেছি। পরে নিজের ভেতরে এক ধরণের অনুশোচনাও কাজ করা শুরু করলো; মনে হতে লাগলো, এভাবে তাঁকে অপ্রস্তত করা মোটেই ঠিক হয় নাই।

তবে মিশেল ফুকো পড়াতে গেলে--যদিও ফুকো নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন আছে--আমার এই ঘটনার কথা কখনও কখনও ছাত্রছাত্রীদের বলি এইটা বুঝিয়ে যে, প্রতিষ্ঠান আর প্রতিষ্ঠিতরা ক্ষমতাবলে জ্ঞান উৎপাদন করে এবং তাকে জায়েজ করে, আর কেবল নিছক জ্ঞানই ক্ষমতার উৎস নয়।

তবে এও সত্য যে, নেরুদা প্রতিষ্ঠিত হন আর না হন, তিনি আমার প্রিয় কবি--প্রাণের প্রিয় কবি।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.