নন্দনতত্ত্ব || আজফার হোসেন
'এসথেটিকস' নিয়ে কয়েকটা কথা শেয়ার না করে পারছি না।
প্রথমে আসি 'নান্দনিকতার ঘোর' তৈরি করা প্রসঙ্গে। নান্দনিকতার ঘোর এই অর্থে যে, যখন আমরা কেবল সৌন্দর্যের দোহাই পেড়ে বাদ বাকী বিষয়গুলোকে সৌন্দর্য থেকে বিছিন্ন করতে থাকি, তখন আমরা একটা ঘোর তৈরি করি।
আমি একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। একজন পরিচিত লোকের সঙ্গে আমার দেখা হয় ঢাকায়; তিনি সালমান রুশদীর খুব ভক্ত। তো, দেখা মাত্রই আমাকে তিনি প্রশ্ন করলেন: "আপনি সালমান রুশদীর 'অমোক' উপন্যাসটা পড়েছেন?" আমি বললাম, হ্যাঁ পড়েছি। তার উত্তরে তিনি বললেন, "ওহ! কী দারুণ তাই না?" আবার জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি কি 'তমোক' উপন্যাসটা পড়েছেন?" আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ "ওহ! বিউটিফুল!" এমন করে যেটিই বলছি যে পড়েছি, তার উত্তরে তিনি বলেই চলেছেনঃ ওহ! আহ! দারুণ ইত্যাদি। আমি তাকে বললামঃ কী ওহ! বা কী বিউটিফুল? তিনি বললেন, "দেখেছেনই তো, ইংরেজি ভাষাটাকে কী দারুণভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ওইসব উপন্যাসে!"
এই যে কেবল ইংরেজির মোহে পড়ে অন্য আর সব কিছু যে তার চোখে লাগছে না, তার ফলে সে একটা পুনরাবৃত্তির মধ্যে আটকে আছে। কিন্তু সেটা তো আমাদেরকে বেশি দূর নিয়ে যায় না। তো, নান্দনিকতার ঘোর হচ্ছে সেই ঘোর যার ফলে আমরা সৌন্দর্যের বিষয়টাকে পৃথিবীর তাবৎ অনুশীলনের ক্ষেত্র থেকে ছিনতাই করে কেবল 'সৌন্দর্য'টা আমরা দেখতে থাকি। এটা একধরনের ‘ভায়োলেন্স’ও বটে, যার ফলে ‘সৌন্দর্য’কে কতটা সৌন্দর্য বলা যায় তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। এছাড়া সৌন্দর্যের ধারণাটা যে ঐতিহাসিকভাবে উৎপাদিত এবং সামাজিকভাবে ‘কনস্ট্রাকটেড্', সেই বিষয়টাকে ঘোরের জোরে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার রেওয়াজ তো বুর্জোয়া আর উপনিবেশবাদী নন্দনতত্ত্বের বিভিন্ন কিসিমের প্ররোচনায় জারি তো আছেই।
কিন্তু মানুষের সৃজনশীলতার ইতিহাসই স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে, ‘সৌন্দর্য’ মোটেই মতাদর্শনিরপেক্ষ নয়। হ্যাঁ, বাংলাদেশের একজন কৃষক যাকে সুন্দর বলেন, তাকে তো পিকাসোর সমঝদার সুন্দর না-ও বলতে পারেন। ধরা যাক তিরিশের আধুনিকতাবাদের বিষয়টা। কেউ কেউ বলেন যে, বুদ্ধদেব বসু দারুণ লেখেন, চমৎকার গদ্য লেখেন, সুখপাঠ্য গদ্য লেখেন। একেবারে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেন। কিন্তু যখন প্রশ্ন করা হয়, কেন গদ্য সুখপাঠ্য হলো, সুখটা কার, বা কেন একজন কিছু পাঠ করে সুখ পায়, তখন উত্তরে যা মেলে তার নাম ঘোর। নান্দনিকতার ঘোর অনেক সময় কাউকে বড় করতে গিয়ে অন্যকে খারিজ করার প্রবণতাও তৈরি করে।
আবার ধরা যাক, আর এক দল বলে, রাজনীতি নাকি কবিতাক স্পর্শ করলে, নাটককে স্পর্শ করলে, বা শিল্পকে স্পর্শ করলে শিল্পের অযু নষ্ট হয়ে যায়, পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। একজনের সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। তিনি বলছেন, রাজনীতি তার কবিতাকে স্পর্শ করে না এবং তিনি রাজনীতি থেকে বাইরে আছেন। এটার অর্থটা কী? রাজনীতি থেকে কি আমরা বাইরে আছি? রাজনীতি মানে কি কেবল হাসিনা আর খালেদা যা বলেন এবং করেন তাই নাকি? তা তো না।
যেখানেই ক্ষমতা আছে, যেখানেই ক্ষমতা-সম্পর্ক বিরাজ করছে, সেখানেই রাজনীতির প্রসঙ্গটা থাকেই। এই সময়ে বা কোনো সময়ে দাঁড়িয়ে কোনো কবি যখন শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেন, শব্দ এবং বাক্য দিয়ে যখন তিনি ভাষার ক্ষমতাকে পরখ করেন, ভাষার ক্ষমতাকে সম্প্রসারিত করেন, তখন সেই কবি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। শব্দের-বাক্যের বা ভাষার তো একটা ক্ষমতা আছে, ভাষাও ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরি করে, নইলে সে যোগাযোগ স্থাপন করছে কীভাবে? তাহলে এই যে শব্দের ক্ষমতা আছে, ভাষার ক্ষমতা আছে, তার মানেই তো এখানে রাজনীতি আছে--শব্দের রাজনীতি, ভাষার রাজনীতি। তো, এধরনে্র ধারণা যে, রাজনীতি শিল্পে প্রবেশ করলে শিল্পের পবিত্রতা নষ্ট হয়, তা আসলে নান্দনিকতার ঘোরের মধ্যেই জন্ম নেয় এবং প্রচারিত হয়, প্রচলিত থাকে। এসব ধুনফুনকে, এসব ঘোরকে চ্যালেঞ্জ করা দরকার।
একটা জগতের মধ্যে থেকে একটা বিষয়কে দারুণভাবে সেলিব্রেট করে বাকি সব কিছুকে খারিজ করে দেয়া, আমি সেই অর্থেই ঘোরের কথা বলছি। এটাকেও একধরনের 'কমোডিটি ফেটিশিজম' বলা যেতে পারে। রাজনৈতিক অর্থনীতির সূত্র ধরে পণ্যের 'ফেটিশ' কথাটা এসেছে কার্ল মার্কসের কাছ থেকে এবং এটা আমরা ব্যবহার করতে পারি অন্য ক্ষেত্রেও। হ্যাঁ, একটা পণ্য যখন উৎপাদিত হয়, যখন তার ঝকঝকে মোড়কে মূল্যের ট্যাগ বসানো হয়, তখন আমরা কেবল একটা পণ্যকে দেখছি আর পণ্যের মূল্যটাকেই দেখছি। কিন্তু এই পণ্য উৎপাদনের পেছনে যে উৎপাদন-প্রক্রিয়া থাকে, শ্রমিকের রক্তের যে দাগ থাকে, সেগুলোকে কিন্তু আমরা দেখি না। কারণ, দৃশ্যত, ওই ঝকঝকে মোড়কে কোনো রক্তের দাগ নাই।
কিন্তু ওই রক্তের দাগটা দেখা দরকার। তো, যারা কেবল পণ্যের রোশনাই দেখে কিংবা তার ঝকঝকে বা ঝলমলে মোড়কে কেবল দাম দেখে দেখে সুখ পায়, তারাও একধরনের নান্দনিকতার ঘোরের মধ্যে থাকে বলে আমি মনে করি।
প্রথমে আসি 'নান্দনিকতার ঘোর' তৈরি করা প্রসঙ্গে। নান্দনিকতার ঘোর এই অর্থে যে, যখন আমরা কেবল সৌন্দর্যের দোহাই পেড়ে বাদ বাকী বিষয়গুলোকে সৌন্দর্য থেকে বিছিন্ন করতে থাকি, তখন আমরা একটা ঘোর তৈরি করি।
আমি একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। একজন পরিচিত লোকের সঙ্গে আমার দেখা হয় ঢাকায়; তিনি সালমান রুশদীর খুব ভক্ত। তো, দেখা মাত্রই আমাকে তিনি প্রশ্ন করলেন: "আপনি সালমান রুশদীর 'অমোক' উপন্যাসটা পড়েছেন?" আমি বললাম, হ্যাঁ পড়েছি। তার উত্তরে তিনি বললেন, "ওহ! কী দারুণ তাই না?" আবার জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি কি 'তমোক' উপন্যাসটা পড়েছেন?" আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ "ওহ! বিউটিফুল!" এমন করে যেটিই বলছি যে পড়েছি, তার উত্তরে তিনি বলেই চলেছেনঃ ওহ! আহ! দারুণ ইত্যাদি। আমি তাকে বললামঃ কী ওহ! বা কী বিউটিফুল? তিনি বললেন, "দেখেছেনই তো, ইংরেজি ভাষাটাকে কী দারুণভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ওইসব উপন্যাসে!"
এই যে কেবল ইংরেজির মোহে পড়ে অন্য আর সব কিছু যে তার চোখে লাগছে না, তার ফলে সে একটা পুনরাবৃত্তির মধ্যে আটকে আছে। কিন্তু সেটা তো আমাদেরকে বেশি দূর নিয়ে যায় না। তো, নান্দনিকতার ঘোর হচ্ছে সেই ঘোর যার ফলে আমরা সৌন্দর্যের বিষয়টাকে পৃথিবীর তাবৎ অনুশীলনের ক্ষেত্র থেকে ছিনতাই করে কেবল 'সৌন্দর্য'টা আমরা দেখতে থাকি। এটা একধরনের ‘ভায়োলেন্স’ও বটে, যার ফলে ‘সৌন্দর্য’কে কতটা সৌন্দর্য বলা যায় তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। এছাড়া সৌন্দর্যের ধারণাটা যে ঐতিহাসিকভাবে উৎপাদিত এবং সামাজিকভাবে ‘কনস্ট্রাকটেড্', সেই বিষয়টাকে ঘোরের জোরে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার রেওয়াজ তো বুর্জোয়া আর উপনিবেশবাদী নন্দনতত্ত্বের বিভিন্ন কিসিমের প্ররোচনায় জারি তো আছেই।
কিন্তু মানুষের সৃজনশীলতার ইতিহাসই স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে, ‘সৌন্দর্য’ মোটেই মতাদর্শনিরপেক্ষ নয়। হ্যাঁ, বাংলাদেশের একজন কৃষক যাকে সুন্দর বলেন, তাকে তো পিকাসোর সমঝদার সুন্দর না-ও বলতে পারেন। ধরা যাক তিরিশের আধুনিকতাবাদের বিষয়টা। কেউ কেউ বলেন যে, বুদ্ধদেব বসু দারুণ লেখেন, চমৎকার গদ্য লেখেন, সুখপাঠ্য গদ্য লেখেন। একেবারে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেন। কিন্তু যখন প্রশ্ন করা হয়, কেন গদ্য সুখপাঠ্য হলো, সুখটা কার, বা কেন একজন কিছু পাঠ করে সুখ পায়, তখন উত্তরে যা মেলে তার নাম ঘোর। নান্দনিকতার ঘোর অনেক সময় কাউকে বড় করতে গিয়ে অন্যকে খারিজ করার প্রবণতাও তৈরি করে।
আবার ধরা যাক, আর এক দল বলে, রাজনীতি নাকি কবিতাক স্পর্শ করলে, নাটককে স্পর্শ করলে, বা শিল্পকে স্পর্শ করলে শিল্পের অযু নষ্ট হয়ে যায়, পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। একজনের সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। তিনি বলছেন, রাজনীতি তার কবিতাকে স্পর্শ করে না এবং তিনি রাজনীতি থেকে বাইরে আছেন। এটার অর্থটা কী? রাজনীতি থেকে কি আমরা বাইরে আছি? রাজনীতি মানে কি কেবল হাসিনা আর খালেদা যা বলেন এবং করেন তাই নাকি? তা তো না।
যেখানেই ক্ষমতা আছে, যেখানেই ক্ষমতা-সম্পর্ক বিরাজ করছে, সেখানেই রাজনীতির প্রসঙ্গটা থাকেই। এই সময়ে বা কোনো সময়ে দাঁড়িয়ে কোনো কবি যখন শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেন, শব্দ এবং বাক্য দিয়ে যখন তিনি ভাষার ক্ষমতাকে পরখ করেন, ভাষার ক্ষমতাকে সম্প্রসারিত করেন, তখন সেই কবি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। শব্দের-বাক্যের বা ভাষার তো একটা ক্ষমতা আছে, ভাষাও ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরি করে, নইলে সে যোগাযোগ স্থাপন করছে কীভাবে? তাহলে এই যে শব্দের ক্ষমতা আছে, ভাষার ক্ষমতা আছে, তার মানেই তো এখানে রাজনীতি আছে--শব্দের রাজনীতি, ভাষার রাজনীতি। তো, এধরনে্র ধারণা যে, রাজনীতি শিল্পে প্রবেশ করলে শিল্পের পবিত্রতা নষ্ট হয়, তা আসলে নান্দনিকতার ঘোরের মধ্যেই জন্ম নেয় এবং প্রচারিত হয়, প্রচলিত থাকে। এসব ধুনফুনকে, এসব ঘোরকে চ্যালেঞ্জ করা দরকার।
একটা জগতের মধ্যে থেকে একটা বিষয়কে দারুণভাবে সেলিব্রেট করে বাকি সব কিছুকে খারিজ করে দেয়া, আমি সেই অর্থেই ঘোরের কথা বলছি। এটাকেও একধরনের 'কমোডিটি ফেটিশিজম' বলা যেতে পারে। রাজনৈতিক অর্থনীতির সূত্র ধরে পণ্যের 'ফেটিশ' কথাটা এসেছে কার্ল মার্কসের কাছ থেকে এবং এটা আমরা ব্যবহার করতে পারি অন্য ক্ষেত্রেও। হ্যাঁ, একটা পণ্য যখন উৎপাদিত হয়, যখন তার ঝকঝকে মোড়কে মূল্যের ট্যাগ বসানো হয়, তখন আমরা কেবল একটা পণ্যকে দেখছি আর পণ্যের মূল্যটাকেই দেখছি। কিন্তু এই পণ্য উৎপাদনের পেছনে যে উৎপাদন-প্রক্রিয়া থাকে, শ্রমিকের রক্তের যে দাগ থাকে, সেগুলোকে কিন্তু আমরা দেখি না। কারণ, দৃশ্যত, ওই ঝকঝকে মোড়কে কোনো রক্তের দাগ নাই।
কিন্তু ওই রক্তের দাগটা দেখা দরকার। তো, যারা কেবল পণ্যের রোশনাই দেখে কিংবা তার ঝকঝকে বা ঝলমলে মোড়কে কেবল দাম দেখে দেখে সুখ পায়, তারাও একধরনের নান্দনিকতার ঘোরের মধ্যে থাকে বলে আমি মনে করি।
0 comments:
Note: Only a member of this blog may post a comment.