চে গুয়েভারা || আজফার হোসেন
[আজ ১৪ই জুন চে গুয়েভারার জন্মবার্ষিকী। এই উপলক্ষে চে'কে নিয়ে আমার এক দীর্ঘ রচনার খানিকটা অংশ এবং আমার অনুবাদ করা একটা কবিতাও পোস্ট করলাম।]
অতীতে আমরা যা কিছু চিন্তা করেছি এবং অনুভব করেছি, তাদের জমা রাখতে হবে আমাদেরই আর্কাইভে এবং নতুন ধরনের মানুষ তৈরি করতে হবে।
--চে গুয়েভারা
প্রতিদিনের লড়াইয়ের মাঝখানে খানিকটা থেমে, সম্মান সহকারে ও কৃতজ্ঞতায়, আমি নতজানু হই সেই ব্যতিক্রমী যোদ্ধার কাছে, যার নাম চে গুয়েভারা।
--ফিদেল কাস্ত্রো
হাজার বছর ধরে আমি চে গুয়েভারাকে নিয়ে লাখ লাখ পৃষ্ঠা লিখে যেতে পারি।
--গব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
১৯৬৭ সাল। ৯ অক্টোবর। বলিভিয়ার একটি গ্রাম ‘লা হিগেরা’ দুপুর উপুর করে ঢেলে নিয়েছে আছে যত রোদ্দুর। ওই অঢেল রোদ্দুরের ভেতরেই একটি স্কুলঘরে গাঢ় হয়ে উঠেছে আততায়ী অন্ধকার। যে দিশাহীন অন্ধকারে একজন কিউবান গেরিলার চোখের দ্যুতিকে ঠিকঠাক চিনে নিয়ে চে গুয়েভারা নিশানা দিতেন, সেই অন্ধকারের বিপরীতে আরেক অন্ধকারেই জীবন-ছিনিয়ে-নেওয়া বুলেটের শেষ আঘাতের আগেই চে গুয়েভারা বলে উঠলেন, "আমি জানি তোমরা আমাকে মারতে এসেছো। কাপুরুষ, চালাও গুলি! তোমরা কেবল একজন মানুষকেই খুন করতে যাচ্ছ!"
বেলা দেড়টার কিছু আগেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট বলিভিয়ার ডানপন্থি রাষ্ট্রপতি রেনে বারিয়েন্তোসের নির্দেশে বন্দুক গর্জে ওঠে। এভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন চে গুয়েভারা। মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগেই অবশ্য চে গুয়েভারাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি তাঁর দীর্ঘজীবিতা বা অমরত্ব নিয়ে কিছু ভাবছেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, "মোটেই না। বরঞ্চ আমি ভাবছি বিপ্লবের দীর্ঘজীবিতা নিয়ে।"
চে গুয়েভারার আরেকটি বিখ্যাত উচ্চারণ স্মরণ করতে হয়: "যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ একজন আমার বন্দুক হাতে তুলে নেয় এবং লড়াই চালিয়ে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার পতন নিয়ে ভাবিত নই।"
কিন্তু কে হাতে তুলে নিয়েছে চে গুয়েভারার বন্দুক? চে গুয়েভারার ভাষ্য মোতাবেক, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বন্দুক গর্জে-ওঠার অঞ্চল এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার গোটাটাই, যে অঞ্চলগুলো বিশ্বপুঁবিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ও অন্যান্য শোষণের ক্ষেত্র হয়ে আছে দীর্ঘ সময়। তবে জোরেশোরে এও বলা দরকার যে, চে গুয়েভারার মার্কসবাদ কেবল তথাকথিত ‘মেশিনগান মার্কসবাদ’ই নয়। আর নিজের জীবন দিয়েই তো তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ওই মেশিনগান মার্কসবাদের দৌড় কতদূর। এসব প্রসঙ্গ পরে খোলসা করা যাবে। কিন্তু তার আগে চে গুয়েভারার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য উপস্থিত করা যাক।
চে গুয়েভারার আসল নাম আর্নেস্তো গুয়েভারা। আমাদের মওলানা ভাসানী যেমন ‘ভাসানী’ নামটা আসামের ভাসানচর এলাকার জনগণের ভালোবাসার ভেতর দিয়েই অর্জন করেছিলেন, ঠিক তেমনি আর্নেস্তো গুয়েভারার জন্যও ‘চে’ নামটা ছিল ভালোবাসার অর্জন। কথায় কথায় আর্নেস্তো গুয়েভারা ‘চে’ শব্দটা ব্যবহার করতেন। শব্দটির কাছাকাছি অর্থ হচ্ছে ‘বন্ধু’। আবার এটি উষ্ণ সম্বোধনও বটে। গুয়াতেমালায় রাজনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার সময় গুয়েতেমালার জনগণই আর্নেস্তো গুয়েভারাকে চে নামে ডাকা শুরু করেন। সেই থেকে আর্নেস্তো গুয়েভারা হয়ে ওঠেন চে গুয়েভারা।
১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্মগ্রহণ করেন চে গুয়েভারা। পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে চে গুয়েভারা সবার বড়। তাঁর পরিবারের ঝোঁকটা ছিল বাম চিন্তা ও রাজনীতির দিকেই। ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হওয়া শুরু করেন চে গুয়েভারা। অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ছেলেবেলা থেকেই ভালো খেলোয়াড় হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছিলেন চে। ছেলেবেলা থেকেই আরেকটি জিনিসের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। সারাজীবন ধরেই অবশ্য সে আগ্রহ অক্ষুন্ন ছিল। সেই তুমুল আগ্রহের এলাকা হচ্ছে কবিতা। যৌবনে তিনি বিশেষভাবে পড়েছেন যেসব কবিকে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন চিলির কবি পাবলো নেরুদা, পেরুর কবি সেজার ভাইয়ো, চিলির কবি গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং স্পেনের কবি আন্তোনিও মাচাদো ও ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা।
বলা দরকার, আর্জেন্টিনার কবি হোসে হার্নান্দেজ-এর ২ হাজার ৩১৬ পঙক্তির মহাকাব্য _মার্তিন ফিয়েরো_ থেকে পঙক্তির পর পঙক্তি মুখস্থ আউড়াতে পারতেন চে গুয়েভারা। এও বলা দরকার, এই মহাকাব্যটি আর্জেন্টিনার ইউরোপায়িত হওয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে জাতীয় চেতনার বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এছাড়া আরেকটু পরিণত বয়সে লাতিন আমেরিকার আরো কিছু লেখকের প্রতি ঝুঁকে পড়েন চে গুয়েভারা। এই সব লেখকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন উরুগুয়ের লেখক হোরেসিও সিলভেস্ত্রে কিরোগা ফোর্তেজা, চিলির বিপ্লবী কবি ফার্নান্দো আলেগ্রিয়া, ইকুয়েডরের বিখ্যাত নাট্যকার-ঔপনাসিক হর্হে ইকাজা কর্নেল, গুয়াতেমালার নোবেল-পুরস্কার-বিজয়ী কবি ও ঔপন্যাসিক মিগেল এঞ্জেল আস্তুরিয়া এবং অবশ্যই হিস্পানি আধুনিকতাবাদের প্রবক্তা নিকারাগুয়ার কবি রুবেন দারিও।
নিঃসন্দেহে বলা যাবে, লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন চে গুয়েভারা। বক্তৃতায় বা কথোপকথনে তাই সাহিত্য থেকে উদাহরণ দেওয়া বা কবিতা থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করা চে গুয়েভারার অভ্যাস ছিল। এমনকি আখক্ষেতে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে চে গুয়েভারা আখ-শ্রমিকদের হিস্পানি কবি লিওঁ ফেলিপের কবিতা শোনাতেন। তবে, বোধ করি, তাঁর জীবনের শেষদিকে চে গুয়েভারার সবচেয়ে প্রিয় কবি হয়ে ওঠেন কিউবার হোসে মার্তি, যিনি একইসঙ্গে ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রোর প্রিয় উপনিবেশবাদবিরোধী বিপ্লবীও।
বন্ধনীতে এখানে বলে রাখা দরকার, মেক্সিকোর লেখক ও চে’র জীবনীকার পাকো ইগনেসিও'র সম্পাদনায় মেক্সিকোর প্লানেটা নামের প্রকাশনা সংস্থা থেকে মুদ্রিত অক্ষরে বছর কয়েক আগে বেরিয়েছিল চে গুয়েভারার সেই সবুজ নোটবুক, যা পাওয়া গিয়েছিল ১৯৬৭ সালে, বলিভিয়ার সেই আততায়ী মুহূর্তে যখন চে ধরা পড়েছিলেন সিআইএ-সমর্থিত বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর হাতে। কিন্তু কী ছিল ওই নোটবুকে? কোনো গোপন তথ্য? না। বা কোনো সামরিক পরিকল্পনা? তাও না। কোনো রাজনৈতিক মতবাদের খসড়া? সেটাও না।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যে সবুজ নোটবই বুকপকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন কিংবা যুদ্ধ করতেন চে গুয়েভারা, সেই নোটবইয়ে আজ পাওয়া যাচ্ছে তাঁর নিজ হাতে নকল-করা ৬৯টি তাজা টগবগ-করা কবিতা, যেন কবিতার শব্দের সঙ্গে শব্দ ঘষে অন্ধকারে আগুন জ্বালাতেন বিপ্লবী গেরিলা যোদ্ধা চে গুয়েভারা। প্রিয ফিলিস্তিনি কবি রশীদ হাসানের সেই উক্তিটা মনে পড়ে: "একশটি গর্জে-ওঠা রাজনৈতিক বক্তৃতার চেয়েও মাত্র একটি কবিতা মানুষকে বেশি নাড়া দিতে পারে।"
কিন্তু ওই নোটবইয়ের কবিরা কে? প্রথমেই আছেন পাবলো নেরুদা।
আরো আছেন পেরুর কবি সেজার ভাইয়ো এবং কিউবার বিপ্লবী কালো কবি নিকোলাস গিয়েনসহ আরো অনেকে। কিন্তু চে যেমন ভালোবাসেন কবিদের, কবিরাও তেমনি ভালোবাসেন চে গুয়েভারাকে। তাই চে গুয়েভারার চল্লিশতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বেরিয়েছিল _চে ইন ভার্স_ নামের একটা কবিতা-সংকলন। সম্পাদনা করেছেন গ্যাভিন টুল এবং জর্জিনা হিমেনেথ। সংকলনটিতে চে গুয়েভারার উদ্দেশে ৫৩টি দেশের মোট ১৩৪টি কবিতা ও গান স্থান পেয়েছে। কয়েকজন কবির কথা উল্লেখ করতে হয়: আলজেরিয়ার জামেল আমরানি, অ্যাঙ্গেলার জফরে রোচা, আর্জেন্টিনার হুলিয়া কোর্তাজার, মার্তিনিকের অগাস্তে মাকৌবা, চীনের জিয়াঙ ফেই, মিসরের সালমা এল তাউইল, ভিয়েতনামের কু হায় ক্যান, উরুগুয়ের মারিয়ো বেনেদেত্তি, মেক্সিকোর এফরেইন হুয়ের্তা, জামাইকার অ্যান্ড্রু সালকেই, মরক্কোর মোহাম্মদ খায়ের-এদ্দিন, মোজাম্বিকের সেবাস্তিআউ আলবা, রাশিয়ার ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো, সেইন্ট লুসিয়ার ডেরেক ওয়ালকট, নিকারাগুয়ার হর্হে এদুয়ার্দো আরিয়ানো, ভেনিজুয়েলার পাবলো মোরা, জিম্বাবুয়ের কসমাস মারিয়োসি, ভারতের শংকর পিল্লাই, ইরানের সিয়ামাক কিয়াবোস্তামি, কিউবার নিকোলাস গিয়েন, হাইতির রেনে দেপেস্ত্রে, এল সালভাদরের রোকে ডালটন এবং অবশ্যই পাবলো নেরুদা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীজুড়ে কবিতা আর গানের উৎসবে জীবন্ত থাকেন--গুয়াতেমালার কবি ওতো রাউল গনজালেসের ভাষায়--"আমাদের চে।"
সাহিত্য ও কবিতার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি পুরোদস্তুর বিপ্লবী হওয়ার আগেই দর্শন, তত্ত্ব ও রাজনৈতিক মতবাদও খানিকটা অধ্যয়ন করেছিলেন চে গুয়েভারা। মজার ব্যাপার হলো, চে এক সময় গৌতম বুদ্ধ ও অ্যারিস্টটলকে পাশাপাশি রেখে পড়েছিলেন। আবার সিগমুন্ড ফ্রয়েডেও মজেছিলেন খানিকটা। কিন্তু তার আগেই মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনেও তিনি পাঠ নিয়েছেন, যদিও সেই পাঠ ১৯৫৫ সালের আগ পর্যন্ত তেমন গভীর ছিল না।
১৯৪৮ সালে চে গুয়েভারা ডাক্তারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি অফ বুয়েনোস আইরিস-এ ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায়ই ভ্রমণের প্রতি তাঁর তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় বছরখানেক অব্যাহতি নিয়ে চে তাঁর বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোকে নিয়ে মোটরসাইকেলে বেরিয়ে পড়েন দক্ষিণ আমেরিকায়। এই ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই চে লিখে ফেলেন তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত, যার শিরোনাম--ইংরেজি অনুবাদে-- _দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিস_। পরে একই শিরোনামে একটি ছবি তৈরি করা হয় ২০০৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে; কিন্তু ছবিটি চে গুয়েভারার রোমান্টিক ও খানিকটা ‘মাচো' ইমেজকেই সামনে আনার চেষ্টা করেছে, তাঁর চিন্তা-চেতনার রাজনীতিকীকরণের প্রসঙ্গটা বাদ ফেলেই।
জোর দিয়েই বলা দরকার যে, এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই চে গুয়েভারার পুরো সত্তার এক তুমুল রাজনীতিকীকরণ ঘটে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় পেরুর কথা। তাঁর জীবনে পরে গুয়েতামালার ভূমিকা যেমন রয়েছে, তেমনি তার আগে রয়েছে পেরুর ভূমিকাও। এই পেরুতে এসে চে গুয়েভারা একদিকে দেখেন লেপার কলোনিতে মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা আর অন্যদিকে সন্ধান পান লাতিন আমেরিকার অন্যতম মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও রাজনীতিক হোসে কার্লোস মারিয়াতেগি'র কাজের।
পেরুর সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মারিয়াতেগিকে লাতিন আমেরিকার গ্রামসিও বলা হয়। মারিয়াতেগির কাছ থেকে চে শিখেছেন মানুষের দুর্দশার রাজনৈতিক অর্থনীতি আর মার্কসবাদের স্থানীয়করণের ও আত্তীকরণের প্রয়োজনীয়তা। তীব্র দারিদ্র, শোষণ আর অধিকারহীনতাকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করে চে গুয়েভারা তাঁর জীবনের এই মুহূর্তেই বুঝে গিয়েছিলেন যে, সশস্ত্র সংগ্রাম ও লড়াই ছাড়া লাতিন আমেরিকার সর্বসাধারণের মুক্তি সম্ভব নয়। সশস্ত্র সংগ্রাম যে মুক্তির সর্বজনীন ও একমাত্র পথ সেই কথা চে বলেন নাই। কিন্তু ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের দাবিকে চে গুয়েভারা ওই সশস্ত্র লড়াইয়ের নিরিখেই পাঠ করেছিলেন। এও সত্য যে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৃতীয় বিশ্বের বিউপনিবেশিকীকরণ আন্দোলনগুলোর শতকরা ৮০ ভাগ সশস্ত্র লড়াইয়ের লাইন নিয়েছিল, কেননা সাম্রাজ্যবাদের বন্দুকের উত্তরে পাল্টা-বন্দুক অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। স্মরণ করা দরকার যে, তৃতীয় বিশ্বের একাধিক বিউপনিবেশিকীকরণ আন্দোলনের পেছনে কিউবার সশস্ত্র বিপ্লব অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
দক্ষিণ আমেরিকায় ভ্রমণ শেষ করে চে গুয়েভারা অবশ্য ফিরে আসেন আর্জেন্টিনায়। ডাক্তারি ডিগ্রি নেওয়ার পর সনাতন পেশাদারি কাজ করার পরিবর্তে তিনি আবারো আগ্রহী হয়ে উঠলেন ভ্রমণে। কেননা লাতিন আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলের অবস্থাও তিনি নিজ চোখে দেখতে চাইলেন। ১৯৫৩ সালের ৭ জুলাই চে গুয়েভারা বেরিয়ে পড়েন। এবারে বলিভিয়া, আবারো পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস ও এল সালভাদর হয়ে ওঠে চে গুয়েভারার অভীষ্ট গন্তব্য। এসব দেশ ঘুরে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে চে গুয়েভারা এসে উপস্থিত হন গুয়াতেমালায়। এখানে তখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াকোবো আরবেনজ গুজমান জনগণের পক্ষে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক কাজ হাতে নিয়েছেন, যেমন ভূমি সংস্কার।
চে গুয়েভারার মনে হয় তিনি এই গুয়াতেমালায় থেকে যাবেন, কাজ করবেন। আর এখানেই তাঁর প্রথম স্ত্রী হিল্ডা গাদিয়া আকোস্তা'র সঙ্গে চে গুয়েভারার সাক্ষাৎ ঘটে। বিভিন্ন যোগাযোগের কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি হিল্ডা নিজেই চে গুয়েভারাকে মার্কসের রাজনৈতিক অর্থনীতির কাজে ভীষণভাবে আগ্রহী করে তোলেন। হিল্ডা পেশায় অর্থনীতিবিদ। তাঁর আদি জন্মস্থান পেরু।
এখানে এও বলা দরকার যে, এই গুয়াতেমালাতেই নির্বাসনে-থাকা ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবান সহকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে চে গুয়েভারার। কিন্তু চোখের সামনেই আরবেনজের পুরো গণতান্ত্রিক সরকারকে সিআইএ-সমর্থিত ক্যু-এর ভেতর দিয়ে ধসে যেতে দেখেন চে গুয়েভারা। নিমিষেই তিনি বুঝে ফেলেন ১৮২৩ সালে প্রবর্তিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মনরো ডকট্রিন’-এর সমকালীন আধিপত্য, যে মতবাদ অনুসারে পুরো লাতিন আমেরিকাকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বাড়ির উঠানের পশ্চাদভাগ হিসেবে বিবেচনা করে। চে গুয়েভারা এও উপলব্ধি করেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার নিজস্ব স্বার্থেই লাতিন আমেরিকার বা তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলের স্বাধীনতা বা স্বনির্ভরতাকে বরদাশত করবে না। এভাবে চে’র মার্কসবাদও পোক্ত হয়, যে মার্কসবাদ একই সঙ্গে শ্রেণী সংগ্রাম ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে। বলা যাবে যে, চে’র কাছে ধারণাটি দাঁড়ায় প্রায় এ রকমই: সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার আরেক নাম শ্রেণী সংগ্রাম।
কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার মধ্য দিয়েই চে’কে গুয়েতামালা ছেড়ে আসতে হয়। অতঃপর ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চে উপস্থিত হন মেক্সিকোতে। চে’র অভিযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উদ্বোধিত হয় এখানে। এই মেক্সিকোই পাল্টে দেয় চে গুয়েভারার জীবন।
মেক্সিকোতেই তিনি সাক্ষাৎ পান সেই মহান বিপ্লবীর, যাঁর সান্নিধ্য ছাড়া চে গুয়েভারা তাঁর অভীষ্ট বিপ্লবী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারতেন না। সেই বিপ্লবী হচ্ছেন ফিদেল কাস্ত্রো। তিনি তখন কিউবার স্বৈরতান্ত্রিক অধিপতি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দাস বাতিস্তার সরকারকে ধ্বংস করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সাক্ষাতের প্রথম রাতেই কাস্ত্রোর সঙ্গে চে গুয়েভারার একটি দীর্ঘ আলাপ হয়। ওই আলাপ থেকেই কাস্ত্রো ও চে উভয়েই বুঝে যান তাঁদের করণীয় কী। চে গুয়েভারা ঠিক করে ফেলেন তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য হচ্ছে বিপ্লব।
অল্প সময়ের মধ্যেই চে গুয়েভারা গেরিলা যুদ্ধে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। তিনি হয়ে ওঠেন কাস্ত্রোর প্রধান সহযোদ্ধা, প্রধান কমরেড। চলতে থাকে কিউবার বিপ্লবের প্রথম পর্ব: সশস্ত্র লড়াই। যদিও প্রথমে চে গুয়েভারা ডাক্তার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, শিগগিরই তিনি ১৯৫৭ সালেই কমান্ডার পদে উন্নীত হন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত একাধিক তীব্র লড়াইয়ের দৃষ্টান্তমূলক নেতৃত্ব দিয়েছেন চে গুয়েভারা, যদিও সেসব লড়াইয়ের অনুপুঙ্খে যাওয়ার অবকাশ এখানে নেই। তবে অবশ্যই বলতে হবে সান্তা ক্লারার লড়াইয়ের কথা, যার বিজয় চে গুয়েভারাকে সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে একজন দৃষ্টান্তমূলক সমরবিদ ও যোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে। ১৯৫৯ সালে কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বাতিস্তার পতনের ভেতর দিয়ে ও বৈপ্লবিক সরকার গঠনের মাধ্যমে কিউবার বিপ্লবের প্রথম পর্ব ঐতিহাসিক সাফল্য সহকাইে শেষ হয়।
শুরু হয় কিউবার বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্ব: কিউবার পুনর্গঠন। ১৯৫৯ সালেই চে প্রথমে কৃষি-সংস্কার ইনস্টিটিউটের প্রধান নিযুক্ত হন। একই বছর তিনি জাতীয় ব্যাংকের সভাপতিও হন। এরপর ১৯৬১ সালের শেষ দিকে তিনি শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই চে গুয়েভারা আবার রাজনৈতিক অর্থনীতিতেও তাত্ত্বিকভাবে মনোনিবেশ করেন। এরপর ১৯৬৫ সালেই চে কিউবার কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা হন। তাহলে কী ধরনের মার্কসবাদ কাজ করেছে এখানে? কাজ করেছে মার্কসবাদের সেই তৃতীয়-বিশ্বায়িত রূপ যেখানে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের একটি বিশেষ পর্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-গঠনের প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিকভাবেই তৃতীয় বিশ্বের বা ত্রিমহাদেশীয় মার্কসবাদের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে এটাই। কালো মার্কসবাদী তাত্ত্বিক সি এল আর জেইমসের একটি উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে: "সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বায়নের ভেতর দিয়েই লেনিনই জাতীয় মুক্তির লড়াইকে তৃতীয় বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদের অন্যতম এজেন্ডা করেছিলেন।" হ্যাঁ, কিউবার বিপ্লব প্রথমত ছিল জাতীয় মুক্তির লড়াই; পরে তার অভিমুখ হয়েছে সমাজতান্ত্রিক। কাস্ত্রো ও চে উভয়েই বিষয়টিকে দেখেছেন এ ভাবেই এবং প্রায় একইভাবে ফ্রানৎস ফানো তাঁর _দ্য রেচেন্ড অফ আর্থ_- এ লড়াই ও বিপ্লবকে দেখেছেন ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক’ রাষ্ট্র-গঠনের আগে ও পরে।
কিন্তু কিউবার বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ের সঙ্গে বেশি দিন সরাসরি যুক্ত থাকেন নাই চে গুয়েভারা। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চে গুয়েভারা আবার কিউবার প্রতিনিধি হিসেবে ইউএনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বলেছেন এবং এক সময় ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের একজন অকুণ্ঠ সমর্থক হিসেবে কাজ করে গেছেন।
এরপর ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে তিনি কিউবা থেকে বিদায় নেন। সশস্ত্র লড়াই যেন তাঁর নেশায় রূপান্তরিত হয়। মরিয়া হয়ে উঠেন কিউবার বিপ্লবকে অন্যত্র নিয়ে যাওযার জন্য। এখানেই তিনি খানিকটা সরে আসেন পেরুর মার্কসবাদী তাত্ত্বিক মারিয়াতেগি'র দেখানো পথ থেকে। মারিয়াতেগি বলেছিলেন লড়াইয়ের নির্দিষ্টবাচকতার কথা; জোর দিয়েছিলেন নির্দিষ্ট অঞ্চলের নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ওপর। কিন্তু লড়াইয়ের নেশায় চে গুয়েভারা চলে যান কঙ্গোতে। তবে সেখানে তিনি সুবিধা করতে না পেরে গোপনে কিউবায় ফিরে আসেন ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে। এরপর বলিভিয়ার সামরিক স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সেখানে তিনি হাজির হন ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে। শুরু করেন গেরিলা লড়াই। ধরা পড়েন সিআইএ চালিত বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর হাতে। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর চে গুয়েভারাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
চে গুয়েভারা: তাঁর মৃত্যু নয়, জীবনটাই সত্য
বলা দরকার, ওপরে চে’র মহাকাব্যিক অভিযাত্রার একটি রেখালেখ্য উপস্থিত করা হয়েছে মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু এই রেখালেখ্যই নির্দেশ করে চে’র দুর্মদ যৌবনের উদীপ্ত কর্মশক্তি, উচ্ছ্বল প্রাণপ্রাচুর্য, অটুট আত্মপ্রত্যয় আর সাফল্যের অদম্য স্পৃহা। কিন্তু শুধু সাফল্য দিয়েই চে গুয়েভারাকে চেনা যাবে না; ব্যর্থতাও লেখে তার নাম চে’র বৈপ্লবিক অভিযাত্রায়। কিন্তু এই ব্যর্থতাও ইতিহাসে চূড়ান্ত নয়। চে’র প্রাথমিক সাফল্য জ্বলজ্বল করে কিউবার অস্তিত্বেই। হ্যাঁ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একেবারে নাকের ডগায় কিউবা টিকে আছে আপন বৈভবে, আপন সমৃদ্ধির দৃষ্টান্ত হয়েই, যদিও কিউবা কোন স্বর্গ নয় (সেটি আরেক প্রসঙ্গ)। তবে কিউবার ইতিহাসেই চে থাকেন এবং তিনি যে থাকবেন, তাও গাঢ় হয়ে থাকে ফিদেল কাস্ত্রোকে নিয়ে লেখা চে গুয়েভারার একটি নিজের কবিতায়। সেই কবিতা থেকে পঙক্তি:
আপনি বলেছিলেন সূর্য জাগবে
তাহলে চলুন
মানচিত্রের না-আঁকা পথে...
... আমাদের
কপালে জ্বলজ্বল করে কালো বিপ্লবী নক্ষত্র
বিজয় কিংবা মৃত্যুর বাইরে অভিযাত্রায়
আপনার কণ্ঠস্বর চারটি হাওয়ায়:
মাটির গতরে, সুবিচারে, খাবার সানকিতে, মুক্তিতে
আমরা থাকবো অভিন্ন কণ্ঠস্বর নিয়ে
আপনার পাশেই।
অর্থাৎ এখনো চে গুয়েভারা থাকেন ওই না-আঁকা পথেই, সম্ভাবনার বিস্তারে, মুক্তির লড়াইয়ে। বর্তমান সময়ে চে’র তাৎপর্য ধরার জন্য আরেকটি কবিতার দিকে তাকানো যেতে পারে। আমার তর্জমায় তরুণ আরব মার্কসবাদী কবি সায়েফ আল আবদুল্লাহর একটি কবিতা--
সাঁই করে একটা বুলেট আপনার কানের পাশ
দিয়ে চলে যায়: তাঁরপর তাক করে আপনার বুক।
খুন ঝরে হরফের ওপর, ইতিহাসের ছন্দে ছন্দে দুলে ওঠে
আপনার দেহ: কবিতার পঙক্তিগুলো ঝলক দিয়ে
ওঠে সাম্রাজ্যের চাপানো অন্ধকারে, একের পর এক--
আপনি জেগে উঠেন, মহান চে গুয়েভারা,
এশিয়ায়, আফ্রিকায়, লাতিন আমেরিকায়।
দেহ-চাবগানো হাউমাউ-খাও-করা পুঁজির বিরুদ্ধে
শ্রমিকের সঞ্চিত দগদগে ক্ষতে আপনি থাকেন।
সাম্রাজ্যের দুনিয়াজোড়া সীমানায় আপনি থাকেন:
এক হাতে পাবলো নেরুদা, অন্য হাতে বিপ্লবের পতাকা।
মাও, মার্তি, মারিয়াতেগি যে নিশানায় চলেন--
সেই নিশানায় মার্কসের তত্ত্বকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে
আপনি থাকেন, হে মহান চে গুয়েভারা।
পেরু থেকে প্যালেস্টাইন--লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই
আরব জগৎ--লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই
কঙ্গো থেকে কোরিয়ায়--লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই
মেক্সিকো থেকে মৌরিতানিয়া--লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই
নিকারাগুয়া থেকে নেপাল--লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই
কৃষকের জমিনে আর শ্রমিকের ঘামে ঘামে
আদিবাসী আর নারীদের কাতারে কাতারে
কবিতার স্তবকে স্তবকে, সঙ্গীতের তালে তালে
হে মহান চে গুয়েভারা
আপনি আবারো জেগে ওঠার কথা বলেন
আর দেখিয়ে দেন মেশিনগানের চেয়েও বড় অস্ত্র--
যার নাম: মানুষ, নতুন ধরনের মানুষ।
অতীতে আমরা যা কিছু চিন্তা করেছি এবং অনুভব করেছি, তাদের জমা রাখতে হবে আমাদেরই আর্কাইভে এবং নতুন ধরনের মানুষ তৈরি করতে হবে।
--চে গুয়েভারা
প্রতিদিনের লড়াইয়ের মাঝখানে খানিকটা থেমে, সম্মান সহকারে ও কৃতজ্ঞতায়, আমি নতজানু হই সেই ব্যতিক্রমী যোদ্ধার কাছে, যার নাম চে গুয়েভারা।
--ফিদেল কাস্ত্রো
হাজার বছর ধরে আমি চে গুয়েভারাকে নিয়ে লাখ লাখ পৃষ্ঠা লিখে যেতে পারি।
--গব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
১৯৬৭ সাল। ৯ অক্টোবর। বলিভিয়ার একটি গ্রাম ‘লা হিগেরা’ দুপুর উপুর করে ঢেলে নিয়েছে আছে যত রোদ্দুর। ওই অঢেল রোদ্দুরের ভেতরেই একটি স্কুলঘরে গাঢ় হয়ে উঠেছে আততায়ী অন্ধকার। যে দিশাহীন অন্ধকারে একজন কিউবান গেরিলার চোখের দ্যুতিকে ঠিকঠাক চিনে নিয়ে চে গুয়েভারা নিশানা দিতেন, সেই অন্ধকারের বিপরীতে আরেক অন্ধকারেই জীবন-ছিনিয়ে-নেওয়া বুলেটের শেষ আঘাতের আগেই চে গুয়েভারা বলে উঠলেন, "আমি জানি তোমরা আমাকে মারতে এসেছো। কাপুরুষ, চালাও গুলি! তোমরা কেবল একজন মানুষকেই খুন করতে যাচ্ছ!"
বেলা দেড়টার কিছু আগেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট বলিভিয়ার ডানপন্থি রাষ্ট্রপতি রেনে বারিয়েন্তোসের নির্দেশে বন্দুক গর্জে ওঠে। এভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন চে গুয়েভারা। মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগেই অবশ্য চে গুয়েভারাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি তাঁর দীর্ঘজীবিতা বা অমরত্ব নিয়ে কিছু ভাবছেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, "মোটেই না। বরঞ্চ আমি ভাবছি বিপ্লবের দীর্ঘজীবিতা নিয়ে।"
চে গুয়েভারার আরেকটি বিখ্যাত উচ্চারণ স্মরণ করতে হয়: "যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ একজন আমার বন্দুক হাতে তুলে নেয় এবং লড়াই চালিয়ে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার পতন নিয়ে ভাবিত নই।"
কিন্তু কে হাতে তুলে নিয়েছে চে গুয়েভারার বন্দুক? চে গুয়েভারার ভাষ্য মোতাবেক, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বন্দুক গর্জে-ওঠার অঞ্চল এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার গোটাটাই, যে অঞ্চলগুলো বিশ্বপুঁবিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ও অন্যান্য শোষণের ক্ষেত্র হয়ে আছে দীর্ঘ সময়। তবে জোরেশোরে এও বলা দরকার যে, চে গুয়েভারার মার্কসবাদ কেবল তথাকথিত ‘মেশিনগান মার্কসবাদ’ই নয়। আর নিজের জীবন দিয়েই তো তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ওই মেশিনগান মার্কসবাদের দৌড় কতদূর। এসব প্রসঙ্গ পরে খোলসা করা যাবে। কিন্তু তার আগে চে গুয়েভারার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য উপস্থিত করা যাক।
চে গুয়েভারার আসল নাম আর্নেস্তো গুয়েভারা। আমাদের মওলানা ভাসানী যেমন ‘ভাসানী’ নামটা আসামের ভাসানচর এলাকার জনগণের ভালোবাসার ভেতর দিয়েই অর্জন করেছিলেন, ঠিক তেমনি আর্নেস্তো গুয়েভারার জন্যও ‘চে’ নামটা ছিল ভালোবাসার অর্জন। কথায় কথায় আর্নেস্তো গুয়েভারা ‘চে’ শব্দটা ব্যবহার করতেন। শব্দটির কাছাকাছি অর্থ হচ্ছে ‘বন্ধু’। আবার এটি উষ্ণ সম্বোধনও বটে। গুয়াতেমালায় রাজনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার সময় গুয়েতেমালার জনগণই আর্নেস্তো গুয়েভারাকে চে নামে ডাকা শুরু করেন। সেই থেকে আর্নেস্তো গুয়েভারা হয়ে ওঠেন চে গুয়েভারা।
১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্মগ্রহণ করেন চে গুয়েভারা। পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে চে গুয়েভারা সবার বড়। তাঁর পরিবারের ঝোঁকটা ছিল বাম চিন্তা ও রাজনীতির দিকেই। ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হওয়া শুরু করেন চে গুয়েভারা। অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ছেলেবেলা থেকেই ভালো খেলোয়াড় হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছিলেন চে। ছেলেবেলা থেকেই আরেকটি জিনিসের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। সারাজীবন ধরেই অবশ্য সে আগ্রহ অক্ষুন্ন ছিল। সেই তুমুল আগ্রহের এলাকা হচ্ছে কবিতা। যৌবনে তিনি বিশেষভাবে পড়েছেন যেসব কবিকে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন চিলির কবি পাবলো নেরুদা, পেরুর কবি সেজার ভাইয়ো, চিলির কবি গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং স্পেনের কবি আন্তোনিও মাচাদো ও ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা।
বলা দরকার, আর্জেন্টিনার কবি হোসে হার্নান্দেজ-এর ২ হাজার ৩১৬ পঙক্তির মহাকাব্য _মার্তিন ফিয়েরো_ থেকে পঙক্তির পর পঙক্তি মুখস্থ আউড়াতে পারতেন চে গুয়েভারা। এও বলা দরকার, এই মহাকাব্যটি আর্জেন্টিনার ইউরোপায়িত হওয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে জাতীয় চেতনার বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এছাড়া আরেকটু পরিণত বয়সে লাতিন আমেরিকার আরো কিছু লেখকের প্রতি ঝুঁকে পড়েন চে গুয়েভারা। এই সব লেখকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন উরুগুয়ের লেখক হোরেসিও সিলভেস্ত্রে কিরোগা ফোর্তেজা, চিলির বিপ্লবী কবি ফার্নান্দো আলেগ্রিয়া, ইকুয়েডরের বিখ্যাত নাট্যকার-ঔপনাসিক হর্হে ইকাজা কর্নেল, গুয়াতেমালার নোবেল-পুরস্কার-বিজয়ী কবি ও ঔপন্যাসিক মিগেল এঞ্জেল আস্তুরিয়া এবং অবশ্যই হিস্পানি আধুনিকতাবাদের প্রবক্তা নিকারাগুয়ার কবি রুবেন দারিও।
নিঃসন্দেহে বলা যাবে, লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন চে গুয়েভারা। বক্তৃতায় বা কথোপকথনে তাই সাহিত্য থেকে উদাহরণ দেওয়া বা কবিতা থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করা চে গুয়েভারার অভ্যাস ছিল। এমনকি আখক্ষেতে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে চে গুয়েভারা আখ-শ্রমিকদের হিস্পানি কবি লিওঁ ফেলিপের কবিতা শোনাতেন। তবে, বোধ করি, তাঁর জীবনের শেষদিকে চে গুয়েভারার সবচেয়ে প্রিয় কবি হয়ে ওঠেন কিউবার হোসে মার্তি, যিনি একইসঙ্গে ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রোর প্রিয় উপনিবেশবাদবিরোধী বিপ্লবীও।
বন্ধনীতে এখানে বলে রাখা দরকার, মেক্সিকোর লেখক ও চে’র জীবনীকার পাকো ইগনেসিও'র সম্পাদনায় মেক্সিকোর প্লানেটা নামের প্রকাশনা সংস্থা থেকে মুদ্রিত অক্ষরে বছর কয়েক আগে বেরিয়েছিল চে গুয়েভারার সেই সবুজ নোটবুক, যা পাওয়া গিয়েছিল ১৯৬৭ সালে, বলিভিয়ার সেই আততায়ী মুহূর্তে যখন চে ধরা পড়েছিলেন সিআইএ-সমর্থিত বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর হাতে। কিন্তু কী ছিল ওই নোটবুকে? কোনো গোপন তথ্য? না। বা কোনো সামরিক পরিকল্পনা? তাও না। কোনো রাজনৈতিক মতবাদের খসড়া? সেটাও না।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যে সবুজ নোটবই বুকপকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন কিংবা যুদ্ধ করতেন চে গুয়েভারা, সেই নোটবইয়ে আজ পাওয়া যাচ্ছে তাঁর নিজ হাতে নকল-করা ৬৯টি তাজা টগবগ-করা কবিতা, যেন কবিতার শব্দের সঙ্গে শব্দ ঘষে অন্ধকারে আগুন জ্বালাতেন বিপ্লবী গেরিলা যোদ্ধা চে গুয়েভারা। প্রিয ফিলিস্তিনি কবি রশীদ হাসানের সেই উক্তিটা মনে পড়ে: "একশটি গর্জে-ওঠা রাজনৈতিক বক্তৃতার চেয়েও মাত্র একটি কবিতা মানুষকে বেশি নাড়া দিতে পারে।"
কিন্তু ওই নোটবইয়ের কবিরা কে? প্রথমেই আছেন পাবলো নেরুদা।
আরো আছেন পেরুর কবি সেজার ভাইয়ো এবং কিউবার বিপ্লবী কালো কবি নিকোলাস গিয়েনসহ আরো অনেকে। কিন্তু চে যেমন ভালোবাসেন কবিদের, কবিরাও তেমনি ভালোবাসেন চে গুয়েভারাকে। তাই চে গুয়েভারার চল্লিশতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বেরিয়েছিল _চে ইন ভার্স_ নামের একটা কবিতা-সংকলন। সম্পাদনা করেছেন গ্যাভিন টুল এবং জর্জিনা হিমেনেথ। সংকলনটিতে চে গুয়েভারার উদ্দেশে ৫৩টি দেশের মোট ১৩৪টি কবিতা ও গান স্থান পেয়েছে। কয়েকজন কবির কথা উল্লেখ করতে হয়: আলজেরিয়ার জামেল আমরানি, অ্যাঙ্গেলার জফরে রোচা, আর্জেন্টিনার হুলিয়া কোর্তাজার, মার্তিনিকের অগাস্তে মাকৌবা, চীনের জিয়াঙ ফেই, মিসরের সালমা এল তাউইল, ভিয়েতনামের কু হায় ক্যান, উরুগুয়ের মারিয়ো বেনেদেত্তি, মেক্সিকোর এফরেইন হুয়ের্তা, জামাইকার অ্যান্ড্রু সালকেই, মরক্কোর মোহাম্মদ খায়ের-এদ্দিন, মোজাম্বিকের সেবাস্তিআউ আলবা, রাশিয়ার ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো, সেইন্ট লুসিয়ার ডেরেক ওয়ালকট, নিকারাগুয়ার হর্হে এদুয়ার্দো আরিয়ানো, ভেনিজুয়েলার পাবলো মোরা, জিম্বাবুয়ের কসমাস মারিয়োসি, ভারতের শংকর পিল্লাই, ইরানের সিয়ামাক কিয়াবোস্তামি, কিউবার নিকোলাস গিয়েন, হাইতির রেনে দেপেস্ত্রে, এল সালভাদরের রোকে ডালটন এবং অবশ্যই পাবলো নেরুদা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীজুড়ে কবিতা আর গানের উৎসবে জীবন্ত থাকেন--গুয়াতেমালার কবি ওতো রাউল গনজালেসের ভাষায়--"আমাদের চে।"
সাহিত্য ও কবিতার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি পুরোদস্তুর বিপ্লবী হওয়ার আগেই দর্শন, তত্ত্ব ও রাজনৈতিক মতবাদও খানিকটা অধ্যয়ন করেছিলেন চে গুয়েভারা। মজার ব্যাপার হলো, চে এক সময় গৌতম বুদ্ধ ও অ্যারিস্টটলকে পাশাপাশি রেখে পড়েছিলেন। আবার সিগমুন্ড ফ্রয়েডেও মজেছিলেন খানিকটা। কিন্তু তার আগেই মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনেও তিনি পাঠ নিয়েছেন, যদিও সেই পাঠ ১৯৫৫ সালের আগ পর্যন্ত তেমন গভীর ছিল না।
১৯৪৮ সালে চে গুয়েভারা ডাক্তারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি অফ বুয়েনোস আইরিস-এ ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায়ই ভ্রমণের প্রতি তাঁর তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় বছরখানেক অব্যাহতি নিয়ে চে তাঁর বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোকে নিয়ে মোটরসাইকেলে বেরিয়ে পড়েন দক্ষিণ আমেরিকায়। এই ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই চে লিখে ফেলেন তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত, যার শিরোনাম--ইংরেজি অনুবাদে-- _দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিস_। পরে একই শিরোনামে একটি ছবি তৈরি করা হয় ২০০৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে; কিন্তু ছবিটি চে গুয়েভারার রোমান্টিক ও খানিকটা ‘মাচো' ইমেজকেই সামনে আনার চেষ্টা করেছে, তাঁর চিন্তা-চেতনার রাজনীতিকীকরণের প্রসঙ্গটা বাদ ফেলেই।
জোর দিয়েই বলা দরকার যে, এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই চে গুয়েভারার পুরো সত্তার এক তুমুল রাজনীতিকীকরণ ঘটে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় পেরুর কথা। তাঁর জীবনে পরে গুয়েতামালার ভূমিকা যেমন রয়েছে, তেমনি তার আগে রয়েছে পেরুর ভূমিকাও। এই পেরুতে এসে চে গুয়েভারা একদিকে দেখেন লেপার কলোনিতে মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা আর অন্যদিকে সন্ধান পান লাতিন আমেরিকার অন্যতম মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও রাজনীতিক হোসে কার্লোস মারিয়াতেগি'র কাজের।
পেরুর সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মারিয়াতেগিকে লাতিন আমেরিকার গ্রামসিও বলা হয়। মারিয়াতেগির কাছ থেকে চে শিখেছেন মানুষের দুর্দশার রাজনৈতিক অর্থনীতি আর মার্কসবাদের স্থানীয়করণের ও আত্তীকরণের প্রয়োজনীয়তা। তীব্র দারিদ্র, শোষণ আর অধিকারহীনতাকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করে চে গুয়েভারা তাঁর জীবনের এই মুহূর্তেই বুঝে গিয়েছিলেন যে, সশস্ত্র সংগ্রাম ও লড়াই ছাড়া লাতিন আমেরিকার সর্বসাধারণের মুক্তি সম্ভব নয়। সশস্ত্র সংগ্রাম যে মুক্তির সর্বজনীন ও একমাত্র পথ সেই কথা চে বলেন নাই। কিন্তু ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের দাবিকে চে গুয়েভারা ওই সশস্ত্র লড়াইয়ের নিরিখেই পাঠ করেছিলেন। এও সত্য যে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৃতীয় বিশ্বের বিউপনিবেশিকীকরণ আন্দোলনগুলোর শতকরা ৮০ ভাগ সশস্ত্র লড়াইয়ের লাইন নিয়েছিল, কেননা সাম্রাজ্যবাদের বন্দুকের উত্তরে পাল্টা-বন্দুক অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। স্মরণ করা দরকার যে, তৃতীয় বিশ্বের একাধিক বিউপনিবেশিকীকরণ আন্দোলনের পেছনে কিউবার সশস্ত্র বিপ্লব অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
দক্ষিণ আমেরিকায় ভ্রমণ শেষ করে চে গুয়েভারা অবশ্য ফিরে আসেন আর্জেন্টিনায়। ডাক্তারি ডিগ্রি নেওয়ার পর সনাতন পেশাদারি কাজ করার পরিবর্তে তিনি আবারো আগ্রহী হয়ে উঠলেন ভ্রমণে। কেননা লাতিন আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলের অবস্থাও তিনি নিজ চোখে দেখতে চাইলেন। ১৯৫৩ সালের ৭ জুলাই চে গুয়েভারা বেরিয়ে পড়েন। এবারে বলিভিয়া, আবারো পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস ও এল সালভাদর হয়ে ওঠে চে গুয়েভারার অভীষ্ট গন্তব্য। এসব দেশ ঘুরে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে চে গুয়েভারা এসে উপস্থিত হন গুয়াতেমালায়। এখানে তখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াকোবো আরবেনজ গুজমান জনগণের পক্ষে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক কাজ হাতে নিয়েছেন, যেমন ভূমি সংস্কার।
চে গুয়েভারার মনে হয় তিনি এই গুয়াতেমালায় থেকে যাবেন, কাজ করবেন। আর এখানেই তাঁর প্রথম স্ত্রী হিল্ডা গাদিয়া আকোস্তা'র সঙ্গে চে গুয়েভারার সাক্ষাৎ ঘটে। বিভিন্ন যোগাযোগের কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি হিল্ডা নিজেই চে গুয়েভারাকে মার্কসের রাজনৈতিক অর্থনীতির কাজে ভীষণভাবে আগ্রহী করে তোলেন। হিল্ডা পেশায় অর্থনীতিবিদ। তাঁর আদি জন্মস্থান পেরু।
এখানে এও বলা দরকার যে, এই গুয়াতেমালাতেই নির্বাসনে-থাকা ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবান সহকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে চে গুয়েভারার। কিন্তু চোখের সামনেই আরবেনজের পুরো গণতান্ত্রিক সরকারকে সিআইএ-সমর্থিত ক্যু-এর ভেতর দিয়ে ধসে যেতে দেখেন চে গুয়েভারা। নিমিষেই তিনি বুঝে ফেলেন ১৮২৩ সালে প্রবর্তিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মনরো ডকট্রিন’-এর সমকালীন আধিপত্য, যে মতবাদ অনুসারে পুরো লাতিন আমেরিকাকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বাড়ির উঠানের পশ্চাদভাগ হিসেবে বিবেচনা করে। চে গুয়েভারা এও উপলব্ধি করেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার নিজস্ব স্বার্থেই লাতিন আমেরিকার বা তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলের স্বাধীনতা বা স্বনির্ভরতাকে বরদাশত করবে না। এভাবে চে’র মার্কসবাদও পোক্ত হয়, যে মার্কসবাদ একই সঙ্গে শ্রেণী সংগ্রাম ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে। বলা যাবে যে, চে’র কাছে ধারণাটি দাঁড়ায় প্রায় এ রকমই: সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার আরেক নাম শ্রেণী সংগ্রাম।
কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার মধ্য দিয়েই চে’কে গুয়েতামালা ছেড়ে আসতে হয়। অতঃপর ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চে উপস্থিত হন মেক্সিকোতে। চে’র অভিযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উদ্বোধিত হয় এখানে। এই মেক্সিকোই পাল্টে দেয় চে গুয়েভারার জীবন।
মেক্সিকোতেই তিনি সাক্ষাৎ পান সেই মহান বিপ্লবীর, যাঁর সান্নিধ্য ছাড়া চে গুয়েভারা তাঁর অভীষ্ট বিপ্লবী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারতেন না। সেই বিপ্লবী হচ্ছেন ফিদেল কাস্ত্রো। তিনি তখন কিউবার স্বৈরতান্ত্রিক অধিপতি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দাস বাতিস্তার সরকারকে ধ্বংস করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সাক্ষাতের প্রথম রাতেই কাস্ত্রোর সঙ্গে চে গুয়েভারার একটি দীর্ঘ আলাপ হয়। ওই আলাপ থেকেই কাস্ত্রো ও চে উভয়েই বুঝে যান তাঁদের করণীয় কী। চে গুয়েভারা ঠিক করে ফেলেন তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য হচ্ছে বিপ্লব।
অল্প সময়ের মধ্যেই চে গুয়েভারা গেরিলা যুদ্ধে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। তিনি হয়ে ওঠেন কাস্ত্রোর প্রধান সহযোদ্ধা, প্রধান কমরেড। চলতে থাকে কিউবার বিপ্লবের প্রথম পর্ব: সশস্ত্র লড়াই। যদিও প্রথমে চে গুয়েভারা ডাক্তার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, শিগগিরই তিনি ১৯৫৭ সালেই কমান্ডার পদে উন্নীত হন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত একাধিক তীব্র লড়াইয়ের দৃষ্টান্তমূলক নেতৃত্ব দিয়েছেন চে গুয়েভারা, যদিও সেসব লড়াইয়ের অনুপুঙ্খে যাওয়ার অবকাশ এখানে নেই। তবে অবশ্যই বলতে হবে সান্তা ক্লারার লড়াইয়ের কথা, যার বিজয় চে গুয়েভারাকে সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে একজন দৃষ্টান্তমূলক সমরবিদ ও যোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে। ১৯৫৯ সালে কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বাতিস্তার পতনের ভেতর দিয়ে ও বৈপ্লবিক সরকার গঠনের মাধ্যমে কিউবার বিপ্লবের প্রথম পর্ব ঐতিহাসিক সাফল্য সহকাইে শেষ হয়।
শুরু হয় কিউবার বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্ব: কিউবার পুনর্গঠন। ১৯৫৯ সালেই চে প্রথমে কৃষি-সংস্কার ইনস্টিটিউটের প্রধান নিযুক্ত হন। একই বছর তিনি জাতীয় ব্যাংকের সভাপতিও হন। এরপর ১৯৬১ সালের শেষ দিকে তিনি শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই চে গুয়েভারা আবার রাজনৈতিক অর্থনীতিতেও তাত্ত্বিকভাবে মনোনিবেশ করেন। এরপর ১৯৬৫ সালেই চে কিউবার কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা হন। তাহলে কী ধরনের মার্কসবাদ কাজ করেছে এখানে? কাজ করেছে মার্কসবাদের সেই তৃতীয়-বিশ্বায়িত রূপ যেখানে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের একটি বিশেষ পর্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-গঠনের প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিকভাবেই তৃতীয় বিশ্বের বা ত্রিমহাদেশীয় মার্কসবাদের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে এটাই। কালো মার্কসবাদী তাত্ত্বিক সি এল আর জেইমসের একটি উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে: "সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বায়নের ভেতর দিয়েই লেনিনই জাতীয় মুক্তির লড়াইকে তৃতীয় বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদের অন্যতম এজেন্ডা করেছিলেন।" হ্যাঁ, কিউবার বিপ্লব প্রথমত ছিল জাতীয় মুক্তির লড়াই; পরে তার অভিমুখ হয়েছে সমাজতান্ত্রিক। কাস্ত্রো ও চে উভয়েই বিষয়টিকে দেখেছেন এ ভাবেই এবং প্রায় একইভাবে ফ্রানৎস ফানো তাঁর _দ্য রেচেন্ড অফ আর্থ_- এ লড়াই ও বিপ্লবকে দেখেছেন ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক’ রাষ্ট্র-গঠনের আগে ও পরে।
কিন্তু কিউবার বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ের সঙ্গে বেশি দিন সরাসরি যুক্ত থাকেন নাই চে গুয়েভারা। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চে গুয়েভারা আবার কিউবার প্রতিনিধি হিসেবে ইউএনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বলেছেন এবং এক সময় ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের একজন অকুণ্ঠ সমর্থক হিসেবে কাজ করে গেছেন।
এরপর ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে তিনি কিউবা থেকে বিদায় নেন। সশস্ত্র লড়াই যেন তাঁর নেশায় রূপান্তরিত হয়। মরিয়া হয়ে উঠেন কিউবার বিপ্লবকে অন্যত্র নিয়ে যাওযার জন্য। এখানেই তিনি খানিকটা সরে আসেন পেরুর মার্কসবাদী তাত্ত্বিক মারিয়াতেগি'র দেখানো পথ থেকে। মারিয়াতেগি বলেছিলেন লড়াইয়ের নির্দিষ্টবাচকতার কথা; জোর দিয়েছিলেন নির্দিষ্ট অঞ্চলের নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ওপর। কিন্তু লড়াইয়ের নেশায় চে গুয়েভারা চলে যান কঙ্গোতে। তবে সেখানে তিনি সুবিধা করতে না পেরে গোপনে কিউবায় ফিরে আসেন ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে। এরপর বলিভিয়ার সামরিক স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সেখানে তিনি হাজির হন ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে। শুরু করেন গেরিলা লড়াই। ধরা পড়েন সিআইএ চালিত বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর হাতে। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর চে গুয়েভারাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
চে গুয়েভারা: তাঁর মৃত্যু নয়, জীবনটাই সত্য
বলা দরকার, ওপরে চে’র মহাকাব্যিক অভিযাত্রার একটি রেখালেখ্য উপস্থিত করা হয়েছে মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু এই রেখালেখ্যই নির্দেশ করে চে’র দুর্মদ যৌবনের উদীপ্ত কর্মশক্তি, উচ্ছ্বল প্রাণপ্রাচুর্য, অটুট আত্মপ্রত্যয় আর সাফল্যের অদম্য স্পৃহা। কিন্তু শুধু সাফল্য দিয়েই চে গুয়েভারাকে চেনা যাবে না; ব্যর্থতাও লেখে তার নাম চে’র বৈপ্লবিক অভিযাত্রায়। কিন্তু এই ব্যর্থতাও ইতিহাসে চূড়ান্ত নয়। চে’র প্রাথমিক সাফল্য জ্বলজ্বল করে কিউবার অস্তিত্বেই। হ্যাঁ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একেবারে নাকের ডগায় কিউবা টিকে আছে আপন বৈভবে, আপন সমৃদ্ধির দৃষ্টান্ত হয়েই, যদিও কিউবা কোন স্বর্গ নয় (সেটি আরেক প্রসঙ্গ)। তবে কিউবার ইতিহাসেই চে থাকেন এবং তিনি যে থাকবেন, তাও গাঢ় হয়ে থাকে ফিদেল কাস্ত্রোকে নিয়ে লেখা চে গুয়েভারার একটি নিজের কবিতায়। সেই কবিতা থেকে পঙক্তি:
আপনি বলেছিলেন সূর্য জাগবে
তাহলে চলুন
মানচিত্রের না-আঁকা পথে...
... আমাদের
কপালে জ্বলজ্বল করে কালো বিপ্লবী নক্ষত্র
বিজয় কিংবা মৃত্যুর বাইরে অভিযাত্রায়
আপনার কণ্ঠস্বর চারটি হাওয়ায়:
মাটির গতরে, সুবিচারে, খাবার সানকিতে, মুক্তিতে
আমরা থাকবো অভিন্ন কণ্ঠস্বর নিয়ে
আপনার পাশেই।
অর্থাৎ এখনো চে গুয়েভারা থাকেন ওই না-আঁকা পথেই, সম্ভাবনার বিস্তারে, মুক্তির লড়াইয়ে। বর্তমান সময়ে চে’র তাৎপর্য ধরার জন্য আরেকটি কবিতার দিকে তাকানো যেতে পারে। আমার তর্জমায় তরুণ আরব মার্কসবাদী কবি সায়েফ আল আবদুল্লাহর একটি কবিতা--
সাঁই করে একটা বুলেট আপনার কানের পাশ
দিয়ে চলে যায়: তাঁরপর তাক করে আপনার বুক।
খুন ঝরে হরফের ওপর, ইতিহাসের ছন্দে ছন্দে দুলে ওঠে
আপনার দেহ: কবিতার পঙক্তিগুলো ঝলক দিয়ে
ওঠে সাম্রাজ্যের চাপানো অন্ধকারে, একের পর এক--
আপনি জেগে উঠেন, মহান চে গুয়েভারা,
এশিয়ায়, আফ্রিকায়, লাতিন আমেরিকায়।
দেহ-চাবগানো হাউমাউ-খাও-করা পুঁজির বিরুদ্ধে
শ্রমিকের সঞ্চিত দগদগে ক্ষতে আপনি থাকেন।
সাম্রাজ্যের দুনিয়াজোড়া সীমানায় আপনি থাকেন:
এক হাতে পাবলো নেরুদা, অন্য হাতে বিপ্লবের পতাকা।
মাও, মার্তি, মারিয়াতেগি যে নিশানায় চলেন--
সেই নিশানায় মার্কসের তত্ত্বকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে
আপনি থাকেন, হে মহান চে গুয়েভারা।
পেরু থেকে প্যালেস্টাইন--লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই
আরব জগৎ--লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই
কঙ্গো থেকে কোরিয়ায়--লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই
মেক্সিকো থেকে মৌরিতানিয়া--লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই
নিকারাগুয়া থেকে নেপাল--লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই
কৃষকের জমিনে আর শ্রমিকের ঘামে ঘামে
আদিবাসী আর নারীদের কাতারে কাতারে
কবিতার স্তবকে স্তবকে, সঙ্গীতের তালে তালে
হে মহান চে গুয়েভারা
আপনি আবারো জেগে ওঠার কথা বলেন
আর দেখিয়ে দেন মেশিনগানের চেয়েও বড় অস্ত্র--
যার নাম: মানুষ, নতুন ধরনের মানুষ।
0 comments:
Note: Only a member of this blog may post a comment.