উপরের নেতি-উস্কে-দেয়া কথাটা লাতিন আমেরিকার লড়াকু লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানো (১৯৪০-২০১৫) তাঁর _মিরারস্_ নামের বইয়ে বিভিন্নভাবেই বুঝিয়ে দ...

সৃষ্টিশীলতা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বাপ-দাদার সম্পত্তি নয় || আজফার হোসেন

11:33 AM Editor 0 Comments





উপরের নেতি-উস্কে-দেয়া কথাটা লাতিন আমেরিকার লড়াকু লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানো (১৯৪০-২০১৫) তাঁর _মিরারস্_ নামের বইয়ে বিভিন্নভাবেই বুঝিয়ে দেন। বইটা নিয়ে অবশ্য এর আগে ফেইসবুকে কিছু কথা বলেছিলাম। তবে খানিকটা ভিন্ন প্রসঙ্গে এবং পরিসরে আবারও বইটা নিয়ে কথা বলার তাগিদ বোধ করছি। কেননা আমার চারপাশে দেখছি সৃষ্টিশীলতা নিয়ে ফালাফালি-করা ‘আমি-কি-হনু-রে’-দের দল, যারা সৃষ্টিশীলতাকে প্রচলিত অর্থের স্বৈরশাসনের বাইরে নিয়ে যেতে একেবারেই নারাজ।

সমস্ত প্রচলিত অর্থ যে আবার অন্তর্নিহিতভাবে ভাল বা খারাপ তা অবশ্য বলেন না গালিয়ানো। কিন্তু কোন্ প্রচলিত অর্থ কিভাবে মানুষের অনুশীলনকে খাটো করে এবং তার ভেতর দিয়েই সমাজে বিভিন্ন ধরনের ‘হায়ারার্কি’ উৎপাদন করে, সেদিকেই বরঞ্চ গালিয়ানো নজর দেন তাঁর _মিরারস্_ নামের বইটাতে। এবং প্রায় সরাসরি সামনে আনেন এই ধারণাটাকেওঃ বস্তাপচা সমাজ সব বস্তাপচা ‘হায়ারার্কি’-ই জিইয়ে রাখে এবং এমনকি তাদের বৈধতা দেয় এমনভাবে যে, মনে হয় যেন তারা নির্ভেজাল, এমনকি চিরন্তন সত্য।

ফিরি সৃষ্টিশীলতা প্রসঙ্গে। সৃষ্টিশীল কারা আসলে? প্রচলিত অর্থে কবি-আঁকিয়ে-সঙ্গীতকার-স্থপতি এবং এই জাতীয় বিশেষ করিৎকর্মাদের সৃষ্টিশীল হিসাবে বিবেচনা করার রেওয়াজ তো আছেই। তাঁরা অবশ্যই সৃষ্টিশীল হতে পারেন। খানিকটা ক্লিশের মতো শোনালেও এও সত্য যে, সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি। তবে, গালিয়ানোর মতে, মানুষের ইতিহাস এও প্রমাণ করেছে যে, কেবল কবিরাই সৃষ্টিশীল নন, কেবল আঁকিয়েরাই সৃষ্টিশীল নন, বা কেবল সঙ্গীতকাররাই সৃষ্টিশীল নন। তাঁরা সৃষ্টিশীল তো বটেই এবং মানুষের ইতিহাসে তাঁদের বিভিন্ন মহৎ অবদানকে অস্বীকার করার অর্থ মানুষকেই অস্বীকার করা। কিন্তু গালিয়ানো এও বোঝান যে, তাঁদের কর্মকাণ্ডের বাইরেও সৃষ্টিশীলতা থাকে। তার সাক্ষী ইতিহাস নিজেই।

অর্থাৎ মানুষের অনুশীলনের ইতিহাসই স্পষ্ট করে বলে দেয় যে, সৃষ্টিশীল হতে পারেন একজন গাণিতিক যেমন, একজন কৃষকও তেমনি; সৃষ্টিশীল হতে পারেন একজন দার্শনিক যেমনি, একজন মেকানিকও তেমনি; সৃষ্টিশীল হতে পারেন একজন শিক্ষক যেমনি, একজন সাংবাদিক বা একজন প্রুফরিডারও তেমনি। যেমন সৃষ্টিশীল হতে পারেন একজন মা, বা যিনি, ধরা যাক, একটা ভীষণ গরিব সংসারের হাল ধরেন। বা একজন মাঝি যিনি নদীর বুকে ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করেন। সৃষ্টিশীল হতে পারেন একজন রাজনীতিবিদও, যেমন সৃষ্টিশীল হতে পারেন একজন খেলোয়াড়, একজন অভিনেতা, একজন অর্থনীতিবিদ, একজন ব্যবস্থাপক, একজন সৈনিক। সৃষ্টিশীল হতে পারেন ‘এমনকি’ একজন কেরানিও, যাঁকে অবশ্য বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কেউ কেউ এলিট কায়দায় সরাসরি—কিংবা উপমা বা রূপক হিসাবে ব্যবহার করে—গালি দিতে বেশ মজা পায়।

বন্ধনীতে এখানে সৃষ্টিশীলতা প্রসঙ্গেই একটা প্রচলিত ‘বাইনারি’ বা বিভাজনের কথা উল্লেখ করতে হয়। যেমন অনেকেই মানুষের লেখালেখি নামের কাজকে ‘সৃষ্টিশীল’ আর ‘মননশীল’ হিসাবে চিহ্নিত করে থাকে এবং তাদের মাঝখানে সীমান্ত তৈরি করার পর সেখানে এমনকি টহল দিতে থাকে। কিন্তু একজন ‘মননশীল’ লেখক কি ‘সৃষ্টিশীল’ হতে পারেন না? বা একজন ‘সৃষ্টিশীল’ লেখক কি হতে পারেন না মননশীল? পারেন। তার প্রমাণ গালিয়ানোর _মিরারস্_ নামের বইটা নিজেই।

তবে গালিয়ানো এও বোঝান যে, সবাই সবসময় যে সৃষ্টিশীল হন তাও কিন্তু নয়। তবে মানুষের যাপিত জীবনের অনুশীলনের সমগ্রেই সৃষ্টিশীলতা বিভিন্ন কায়দায় প্রাসঙ্গিক থাকে বা কাজ করে।
সেদিন একটা আড্ডায় আমার দুজন পরিচিত লোকের কথা-বিনিময় লক্ষ্য করলাম। তারা বন্ধুও। একজন কবি, অপরজন একটা মিউজিক জার্নালের সম্পাদক ও লেখক। তো, কবি ওই সম্পাদককে লক্ষ্য করে বলে উঠলেনঃ “জীবনে কি কখনো তুই একটা ক্রিয়েটিভ লাইন লেইখ্যা দেখাইতে পারছস?” উত্তরে সম্পাদকও একটা আস্ত প্রশ্নই ছুঁড়ে দিলেনঃ “জীবনে কি কখনো তুই সঙ্গীত আর গণিতের সম্পর্ক নিয়া একটা মাথা-ঘুরানো লাইন লেইখ্যা দেখাইতে পারছস?”

আসলে ‘আমি-কি-হনু-রে’-দের দল সৃষ্টিশীলতা নিয়ে বড়াই করে’ ওই সৃষ্টিশীলতার নামেই যান্ত্রিকভাবেই সৃষ্টিশীলতা-বিরোধী ‘হায়ারার্কি’ উৎপাদন করতে থাকে একের পর এক, এই বুঝিয়ে যে, তারা ছাড়া যেন অন্য কেউ অন্য পরিসরে সৃষ্টিশীল হতে পারেন না। এটাও একধরণের ফ্যাসিস্ট মানসিকতা।

0 comments:

Note: Only a member of this blog may post a comment.